Pujor golpo
রণজিৎ গুহ, লেখক, সমাজকর্মী ও প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী:

আমাদের বাড়িতে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় একটা ছোট অনুষ্ঠান হত।আলপনা এঁকে ঘট বসানো হত।আমের পল্লব।একটা ডালায় ফুল পান সুপারি দুর্বা ধান কাঁচা হলুদ বাতাসা মায়ের হাতে তৈরি জিভে গজা কুঁচো নিমকি।বাবা মা উচ্চস্বরে চণ্ডী পাঠ করতেন। প্রথমে অর্গলা স্ত্রোত্র।পরে অন্য অধ্যায়।আমরা ভাইবোনেরা রূপং দেহি জয়ং দেহি বা নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ বলে গলা মেলাতাম। চণ্ডী পাঠের পর সূর্যস্তব শিবের ধ্যান আরও কিছু মন্ত্র সবাই জোরে জোরে বলতাম। এনাম কোথায় ছিল কে আনিলো বল হরিবোল এনাম গোলোকে গোপনে ছিল বল হরিবোল ইত্যাদি একটা লম্বা হরিগান করতাম সকলে মিলে। এরপর হরির লুট।বাবা বাতাসা ছুড়ে ছুড়ে দিতেন। সাথে গান লুট পলো লুট পলো লুট পলোরে/ লাগলো হরির লুটের বাহার লুটে নেরে তোরা/ চিনি সন্দেশ ফুল বাতাসা মণ্ডা জোড়া জোড়া। চৌদিকে খোল করতাল বাজে মধ্যে নাচে গোরা। বাতাসা কুড়িয়ে নিতে ভাইবোনদের একটু হুটোপুটিও হতো। তারপর মা বাবাকে প্রণাম।পিঠোপিঠি ভাইবোনরা বড়জনকে প্রণাম করতে চাইত না। মায়ের বকুনিতে প্রণাম করত।বাবা সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন।  দিদি বোনদের বিয়ের পর ওরা বিজয়ার দিন বাপের বাড়ি আসার চেষ্টা করত এই অনুষ্ঠানে থাকবে বলে।আমাদের ভগ্নীপতিরাও এই অনুষ্ঠানে খুব আন্তরিক ভাবে অংশ নিয়েছেন।আমার বড় ভাগ্নী ভাগ্নেরা এই অনুষ্ঠানে গান গাইত। আমাদের মায়ের গীতা ও চণ্ডী মুখস্থ ছিল। মা ভারত সেবাশ্রম সংঘের গীতাপাঠ প্রতিযোগিতায় প্রথমা নির্বাচিতা হয়েছেন।  ভাইবোনদের মধ্যে একবোন শুভ্রা খুব ভক্তিমতি বরাবর। ওরও মায়ের মতই গীতা চণ্ডী অনেকটা মুখস্থ। মহালয়ার সকালে আকাশবাণীর অনুষ্ঠানতো শুনতামই।বিজয়ার দিন মা বাবার চণ্ডী পাঠ শুনে শুনে আমার আগ্রহ হয় গীতা ও চণ্ডী পাঠের। দুর্গাপুরে তিলকরোড পুজোয়  ষষ্ঠীর সকালে মাইকে চণ্ডী পাঠ করেছি কয়েকবছর। কাছে দূরে নানা সংস্থায় আশ্রমে পাঠ করতে গেছি।সে খুব আদর আপ্যায়নের ব্যাপার। ধুতি মিষ্টি ফলের ঝুড়ি পেতাম।অন্য শহরে এক দুর্গোৎসবে চারদিন সমগ্র চণ্ডী পাঠের আমন্ত্রণ পেলাম।প্রথমদিনের পাঠের পর সকলেই খুব খুশী। অনেকে এসে আলাপ পরিচয় করলেন। ।প্রসংশা করলেন। যে বন্ধু আমাকে নিয়ে গেছিল তারও বেজায় আনন্দ। পরদিন অষ্টমী পুজোর আয়োজন চলছে মণ্ডপে। আমি চণ্ডী পাঠে বসব।পুরোহিত আমায় মানা করলেন। বহুজনেরই আপত্তি তাই পুজো কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অব্রাহ্মণকে দিয়ে  চণ্ডী পাঠ করানো হবে না মণ্ডপে। আমার বন্ধুটি দূরে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে। ব্যাক্তিগত অপমানের চেয়েও বন্ধুটির অপ্রস্তুত অবস্থা আমাকে বেশী পীড়িত করেছিল।

এরপর আমি আর প্রকাশ্যে গীতা বা চণ্ডী পাঠ করিনা। বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানে বা অন্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে পাঠ করেছি অনেক কাল।এখন সেসব অনুষ্টানও নেই।

পুজোর প্রাক্কালে এইসব একান্ত ব্যাক্তিগত কথা মনে পড়ছে।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours