সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর:
সুজলা সুফলা বাংলা মৃত্তিকাময় অঞ্চল এবং এই মৃত্তিকাপূর্ণ বিস্তীর্ণ এলাকা গাঙ্গেয় সমভূমির সাথে একাত্ম হয়ে আছে । তাই বাংলায় এই মাটিই লোক শিল্পের প্রধান উপাদান । নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল ও সেন রাজাদের আমলে পোড়ামাটিতে মার্গরীতির শিল্প চর্চা শুরু হয়েছিল । এই শিল্প চর্চার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলী ও দুই চব্বিশ পরগণায় । বাংলার গ্রামীনজীবনের মানুষেরা ছিলেন অত্যন্ত সরল এবং তাঁদের চিন্তা-ভাবনা, জীবনযাত্রা ও কর্ম পদ্ধতি ছিল গ্রামের সাধারণ জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । গ্রামীন পরিবেশে অনাড়ম্বরপূর্ণ সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি ব্যক্ত হয়েছে এই সাধারণ মানুষগুলোর দেবদেবীর আরাধনায় । তাঁদের কল্পনায়, দেবদেবীর মূর্তিগুলি মূর্ত হয়েছে পোড়ামাটির, ইঁটের খোদাই করা চিত্রে । যাকে বলা হয় – ‘টেরাকোটা’ । দূর্গার কত রূপকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মন্দিরের দেওয়াল গাত্রে । শুধু একচালার মূর্তিই নয় খোপে খোপে আলাদা বসান হয়েছে দেবদেবীকে।
দূর্গাপ্রতিমার বিভিন্ন রূপ উৎকীর্ণ রয়েছে রাঢ় বাংলায় বিভিন্ন মন্দির ভাস্কর্য, দশভূজা থেকে দেবী কোথাও হয়েছেন অষ্টাদশভূজা, কখনও হয়েছেন চতুর্ভূজা । যেমন, মেদেনীপুর জেলার কানাশোল গ্রামের ঝাড়েশ্বরনাথ মন্দির (১৮৩৭) এবং মাঙলোই গ্রামের রাধাদামোদর মন্দির গাত্রে দেবী প্রকাশ পেয়েছেন অষ্টাদশ ভূজা রূপে । আবার পুত্রকন্যা বিহীন দেবীর চতুর্ভূজা মূর্তি দেখতে পাই মুর্শিদাবাদ জেলার গোকর্ণ গ্রামের নরসিংহ মন্দিরে (১৫৮০)।
পোড়ামাটির ফলকে সপুত্রকন্যার দশভুজার মূর্তিতে আমরা দেখি দেবীর দুইপাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং পাশাপাশি দন্ডায়মান গণেশ ও কার্তিক । কিন্তু বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দির (১৬৪৩) মৃন্ময়ীর অন্যরূপ। সেখানে গণেশ ও কার্তিক দুর্গার দুইপাশে এবং লক্ষ্মী ও সরস্বতী দেবীর উপরে । আবার দেবী মূর্তির সামনে বাদ্যরত সেবকদেরও চোখে পড়ে । মেদিনীপুর জেলার সুরথপুর গ্রামের শীতলা মন্দিরের (১৮৪৯) এক ফলক থেকে চোখে পড়ে দুর্গামূর্তির সামনে ছড়হাতে জনৈক বেহালাবাদক । এই জেলারই লাওদাগ্রামের বাঁকা রায়ের মন্দিরে নিবদ্ধ রয়েছে বাজনা বাদ্যরত বাদ্যকরদের মূর্তি । পুরাণ অনুসারে দুর্গার অকালবোধন হয়েছিল স্বয়ং ব্রহ্মার হাতে । কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতে রামচন্দ্রই দেবীর বোধন ও আরাধনা করেছিলেন । এই অকালবোধনের বিভিন্ন চিত্র শিল্পীরা খোদাই করেছেন অনেক মন্দিরগাত্রে । বাঁকুড়া জেলার হদল নারায়ণপুর গ্রামের রাধাদামোদর মন্দিরে দেখা যায় মহিষমর্দিনীর একপাশে জোড়হস্তে রাম এবং অন্যপাশে যুদ্ধরত অবস্থায় রাবণ । একই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে বর্ধমান জেলার কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরে (১৮৪৯) এবং মুর্শিদাবাদ জেলার কাগ্রামের জোড়া শিবমন্দিরে (১৯ শতক) । এই অকালবোধনের একটি সুন্দর দৃশ্য নিবদ্ধ হয়েছে মেদিনীপুর জেলার মালঞ্চ গ্রামের দক্ষিণাকালীর মন্দিরে (১৭১২) ফলকে উৎকীর্ণ রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ দিয়ে উৎপাটিত চক্ষুদানের দৃশ্য।
মন্দিরের গায়ে রামায়ণের দৃশ্য খোদাই করতে গিয়ে শিল্পীরা স্মরণ করেছেন দেবী দশভুজার কথা । কোথাও তিনি আবির্ভূত হয়েছেন কমলেকামিনী রূপে । কোথাও গোধিকারূপিণী চন্ডীর আদলে । রাম-রাবণের ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে দেবী দশভূজার পরিচিত মূর্তি । তবে পূরাণের আদলে মূর্তিকে কল্পনা করা হলেও সিংহকে সর্বদা সিংহের আদলে দেখানো হয়নি । সিংহ কখনও হয়েছে ঘোড়া বা মকরের বিচিত্র আকৃতির । যাকে বলা হয় নরসিংহ-এর প্রতিরূপ।
দেবী দূর্গাকে মন্দির গাত্রে নিবদ্ধ করতে গিয়ে সুন্দর সুন্দর নকসা, জ্যামিতিক অলংকরণ, ফুল-লতাপাতা, চৈতন্যলীলা, পশুপক্ষী ও বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনাবলীর দৃশ্য উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এসবগুলি বাংলা শিল্পীদের পোড়ামাটির অপূর্ব ভাস্কর্য ও অলংকরণের সুন্দর নিদর্শন । খ্রিষ্টীয় সতেরো ও আঠারো শতকের টেরাকোটা মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য তৎকালীন বঙ্গদেশের সামাজিক জীবন চর্চার একটা সুন্দর রূপ প্রকাশ করে । তাঁদের মন্দির চিত্রে গ্রাম্য জীবনের সরলতা ও দেবদেবীর আরাধনার মধ্যেকার এক সুন্দর শান্তভাব ফুটে ওঠে । তবে পোড়ামাটির ফলকে শিল্পীরা দেবী দূর্গাকে কল্পনা করেছেন অবাক করা বিশেষ কয়েকটি রূপে । প্রতিটি রূপে সেই সময়কার সামাজিক চিন্তাধারায় প্রভাব লক্ষ করা যায় । তবে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হল দেবী অসুরসংহারিনী মূর্তির বদলে স্বামী, কন্যা, পুত্রসহ বাঙালী জীবনের শ্বাশত চিত্র সর্বমঙ্গলারূপিনী মূর্তিরও দেখা মেলে । মেদিনীপুর জেলার বহু প্রাচীন পরিবারে এই পারিবারিক মূর্তিকে পুজো করা হয় । এই পারিবারিক জীবন চিত্রও মন্দির গাত্রেও উৎকীর্ণ হয়েছে যা গ্রামীন শিল্পীদের পারিবারিক বন্ধনের লৌকিক ভাবকেই প্রকাশ করে।
সুজলা সুফলা বাংলা মৃত্তিকাময় অঞ্চল এবং এই মৃত্তিকাপূর্ণ বিস্তীর্ণ এলাকা গাঙ্গেয় সমভূমির সাথে একাত্ম হয়ে আছে । তাই বাংলায় এই মাটিই লোক শিল্পের প্রধান উপাদান । নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল ও সেন রাজাদের আমলে পোড়ামাটিতে মার্গরীতির শিল্প চর্চা শুরু হয়েছিল । এই শিল্প চর্চার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলী ও দুই চব্বিশ পরগণায় । বাংলার গ্রামীনজীবনের মানুষেরা ছিলেন অত্যন্ত সরল এবং তাঁদের চিন্তা-ভাবনা, জীবনযাত্রা ও কর্ম পদ্ধতি ছিল গ্রামের সাধারণ জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । গ্রামীন পরিবেশে অনাড়ম্বরপূর্ণ সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি ব্যক্ত হয়েছে এই সাধারণ মানুষগুলোর দেবদেবীর আরাধনায় । তাঁদের কল্পনায়, দেবদেবীর মূর্তিগুলি মূর্ত হয়েছে পোড়ামাটির, ইঁটের খোদাই করা চিত্রে । যাকে বলা হয় – ‘টেরাকোটা’ । দূর্গার কত রূপকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মন্দিরের দেওয়াল গাত্রে । শুধু একচালার মূর্তিই নয় খোপে খোপে আলাদা বসান হয়েছে দেবদেবীকে।
দূর্গাপ্রতিমার বিভিন্ন রূপ উৎকীর্ণ রয়েছে রাঢ় বাংলায় বিভিন্ন মন্দির ভাস্কর্য, দশভূজা থেকে দেবী কোথাও হয়েছেন অষ্টাদশভূজা, কখনও হয়েছেন চতুর্ভূজা । যেমন, মেদেনীপুর জেলার কানাশোল গ্রামের ঝাড়েশ্বরনাথ মন্দির (১৮৩৭) এবং মাঙলোই গ্রামের রাধাদামোদর মন্দির গাত্রে দেবী প্রকাশ পেয়েছেন অষ্টাদশ ভূজা রূপে । আবার পুত্রকন্যা বিহীন দেবীর চতুর্ভূজা মূর্তি দেখতে পাই মুর্শিদাবাদ জেলার গোকর্ণ গ্রামের নরসিংহ মন্দিরে (১৫৮০)।
পোড়ামাটির ফলকে সপুত্রকন্যার দশভুজার মূর্তিতে আমরা দেখি দেবীর দুইপাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং পাশাপাশি দন্ডায়মান গণেশ ও কার্তিক । কিন্তু বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দির (১৬৪৩) মৃন্ময়ীর অন্যরূপ। সেখানে গণেশ ও কার্তিক দুর্গার দুইপাশে এবং লক্ষ্মী ও সরস্বতী দেবীর উপরে । আবার দেবী মূর্তির সামনে বাদ্যরত সেবকদেরও চোখে পড়ে । মেদিনীপুর জেলার সুরথপুর গ্রামের শীতলা মন্দিরের (১৮৪৯) এক ফলক থেকে চোখে পড়ে দুর্গামূর্তির সামনে ছড়হাতে জনৈক বেহালাবাদক । এই জেলারই লাওদাগ্রামের বাঁকা রায়ের মন্দিরে নিবদ্ধ রয়েছে বাজনা বাদ্যরত বাদ্যকরদের মূর্তি । পুরাণ অনুসারে দুর্গার অকালবোধন হয়েছিল স্বয়ং ব্রহ্মার হাতে । কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতে রামচন্দ্রই দেবীর বোধন ও আরাধনা করেছিলেন । এই অকালবোধনের বিভিন্ন চিত্র শিল্পীরা খোদাই করেছেন অনেক মন্দিরগাত্রে । বাঁকুড়া জেলার হদল নারায়ণপুর গ্রামের রাধাদামোদর মন্দিরে দেখা যায় মহিষমর্দিনীর একপাশে জোড়হস্তে রাম এবং অন্যপাশে যুদ্ধরত অবস্থায় রাবণ । একই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে বর্ধমান জেলার কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরে (১৮৪৯) এবং মুর্শিদাবাদ জেলার কাগ্রামের জোড়া শিবমন্দিরে (১৯ শতক) । এই অকালবোধনের একটি সুন্দর দৃশ্য নিবদ্ধ হয়েছে মেদিনীপুর জেলার মালঞ্চ গ্রামের দক্ষিণাকালীর মন্দিরে (১৭১২) ফলকে উৎকীর্ণ রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ দিয়ে উৎপাটিত চক্ষুদানের দৃশ্য।
মন্দিরের গায়ে রামায়ণের দৃশ্য খোদাই করতে গিয়ে শিল্পীরা স্মরণ করেছেন দেবী দশভুজার কথা । কোথাও তিনি আবির্ভূত হয়েছেন কমলেকামিনী রূপে । কোথাও গোধিকারূপিণী চন্ডীর আদলে । রাম-রাবণের ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে দেবী দশভূজার পরিচিত মূর্তি । তবে পূরাণের আদলে মূর্তিকে কল্পনা করা হলেও সিংহকে সর্বদা সিংহের আদলে দেখানো হয়নি । সিংহ কখনও হয়েছে ঘোড়া বা মকরের বিচিত্র আকৃতির । যাকে বলা হয় নরসিংহ-এর প্রতিরূপ।
দেবী দূর্গাকে মন্দির গাত্রে নিবদ্ধ করতে গিয়ে সুন্দর সুন্দর নকসা, জ্যামিতিক অলংকরণ, ফুল-লতাপাতা, চৈতন্যলীলা, পশুপক্ষী ও বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনাবলীর দৃশ্য উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এসবগুলি বাংলা শিল্পীদের পোড়ামাটির অপূর্ব ভাস্কর্য ও অলংকরণের সুন্দর নিদর্শন । খ্রিষ্টীয় সতেরো ও আঠারো শতকের টেরাকোটা মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য তৎকালীন বঙ্গদেশের সামাজিক জীবন চর্চার একটা সুন্দর রূপ প্রকাশ করে । তাঁদের মন্দির চিত্রে গ্রাম্য জীবনের সরলতা ও দেবদেবীর আরাধনার মধ্যেকার এক সুন্দর শান্তভাব ফুটে ওঠে । তবে পোড়ামাটির ফলকে শিল্পীরা দেবী দূর্গাকে কল্পনা করেছেন অবাক করা বিশেষ কয়েকটি রূপে । প্রতিটি রূপে সেই সময়কার সামাজিক চিন্তাধারায় প্রভাব লক্ষ করা যায় । তবে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হল দেবী অসুরসংহারিনী মূর্তির বদলে স্বামী, কন্যা, পুত্রসহ বাঙালী জীবনের শ্বাশত চিত্র সর্বমঙ্গলারূপিনী মূর্তিরও দেখা মেলে । মেদিনীপুর জেলার বহু প্রাচীন পরিবারে এই পারিবারিক মূর্তিকে পুজো করা হয় । এই পারিবারিক জীবন চিত্রও মন্দির গাত্রেও উৎকীর্ণ হয়েছে যা গ্রামীন শিল্পীদের পারিবারিক বন্ধনের লৌকিক ভাবকেই প্রকাশ করে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours