ভুটান পাহাড় এখান থেকে সামান্য দূরে। চিলাপাতা, জলদাপাড়ার ঘন অরণ্য হাতের কাছে। ডুয়ার্সের অপরূপ প্রকৃতি, তন্বী তোর্ষা, ভাওয়াইয়া...সব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটি, যা কিনা একদা কোচবিহার স্টেট বলে পরিচিত ছিল, ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয় ১৯৫০ সালে। অতীতে কোচ সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তার কমে এলেও কোচবিহার রাজ্য শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া সবদিকেই নজর কাড়ে। কোচবিহার রাজপরিবারের সাথে আত্মীয়তা ছিল বা আছে ভারত-বিখ্যাত রাজপরিবারগুলির।
সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রাচীন কোচবিহারকে সেভাবে অনেকেই জানি না আমরা। খুব ব্যথিত হই যখন অনেকে মনে করেন কোচবিহার অসম রাজ্যের বা বিহারের কোনো একটি শহর! বিস্মিত হই। ভাবতে অবাক লাগে কতোটা অজানা রয়ে গেছে কোচবিহার এমনকি তথাকথিত পড়াশোনা জানা মননের কাছেও। মনে রাখতে হবে, কোচবিহার রাজ নরনারায়ণের লেখা চিঠিকে বাংলা গদ্যের প্রথম নিদর্শন মনে করা হয়। ভুলে যেন না যাই কোচবিহার রাজপ্রাসাদ ইতালিয়ান স্থাপত্যের এক অসামান্য নিদর্শন। রাজ্যের রাজধানী কোচবিহার শহরের নকশা আজও যে কোনো স্থপতির কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবী এই রাজপরিবারের বধূ। গায়ত্রী দেবী কোচবিহার-কন্যা। আব্বাসউদ্দিনের ভাওয়াইয়া, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গদ্য, অরুণেশ ঘোষের কবিতায় সমৃদ্ধ কোচবিহার। এই শহর সম্ভবত একমাত্র জেলা শহর যেখানে দেখা যায় চারটি সরকারী বিদ্যালয় ও একটি সরকারী মহাবিদ্যালয়। কোচবিহারের রাসমেলা উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও প্রসিদ্ধ মেলা যার বয়স দ্বি-শতাধিক।
বলা যায় এরকম অনেক কথা। কিন্তু এত বিস্তৃত যাচ্ছি না।
আসলে আগামীকাল ৪ঠা অক্টোবর। আধুনিক কোচবিহারের রূপকার প্রজাবৎসল মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের জন্মদিন।
জন্মাবধি ফালাকাটা-কোচবিহার-দিনহাটা করার জন্য কোচবিহার আমার কাছে ছিল এক স্বপ্নের শহর। রাজার শহর। সেই শহরে ভোরবেলাতে ভিস্তিওয়ালা জলে ভেজাত রাজপথ। প্রশস্ত রাস্তার দু'পাশে সুদৃশ্য বাড়ি, শহরের যে কোনো জায়গা থেকে দৃশ্যমান সুউচ্চ রাজবাড়ির চূড়ো, সাগরদিঘির বিরাট বুকে পরিযায়ী পাখিদের ডানা ঝটপট...মুজনাইয়ের বালকের চোখে স্বপ্ন অঞ্জন মাখিয়ে দিতো সেসময়।
আর বড় হয়ে, কেজো লোক হয়ে এই শহরে মহারাজের নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে মহারাজার প্রতি কেন যেন একটা টান সবসময় অনুভব করি। মনে হয় নিজের সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন তিনি।
তাঁর জন্মদিনের শুভ মুহূর্তের আগে তাই সামান্য দু'চার কথা মহারাজাকে নিয়ে।
১৮৬২ সালের চার অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে ১৮৬৪ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে বসেন। করদ রাজ্য হওয়ায় তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কোচবিহারের তৎকালীন কমিশনার কর্ণেল হটন। হটন সাহেব মহারাজাকে ১৮৬৮ সালে বেনারসের ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করান। পাঁচবছর বাদে ১৮৭২ সালে মহারাজা কোচবিহারে ফিরে আসেন। তখনকার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুনীতি দেবীর সাথে মহারাজার বিয়ে হয় ১৮৭৮ সালে। এই বিয়ে ঘিরে যে ঘটনা ঘটেছিল তা রীতিমতো চমকপ্রদ। তবে আজ সে কথা বিশদে নয়। শুধু এটাই বলার সে আমলে বোধহয় মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই একমাত্র দেশীয় রাজা যিনি বহুবিবাহ করেন নি। সুনীতি দেবীই ছিলেন তাঁর প্রথম ও শেষ প্রেম। এরপর ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে দেশে ফেরেন এবং নানা কর্মকান্ডে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা দেখা যায়। ১৮৮৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাঁর যোগ দেওয়া, জি এস আই উপাধি পাওয়া, সপ্তম এডওয়ার্ডের অনারারি এডিকং পদে সম্মানিত হওয়া-সহ নানা কিছু ঘটে তাঁর জীবনে। ১৮৮৭ সালে দার্জিলিঙে তৈরী করেন লুইস জুবিলি। ১৮৮৮-তে কোচবিহারে ব্রাক্ষ্ম সমাজ নির্মাণের পাশাপাশি তাঁর আর একটি স্মরণীয় কাজ ভিক্টোরিয়া কলেজ (আজকের এ বি এন শীল কলেজ) প্রতিষ্ঠা করা। নিজের রাজ্যে রেলপথ বিস্তার, বিদ্যালয় স্থাপন, চিকিৎসালয় তৈরী অর্থাৎ জনহিতকর কাজের জন্য তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। নারী-স্বাধীনতা, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তা চোখে পড়ার মতো। শিকার নিয়ে তাঁর একটি ইংরেজিতে লেখা বইও আছে। স্টেটের আয়কেও তিনি বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন বহুল পরিমাণে। সুদক্ষ ঘোড়সওয়ার, সুনিপুণ শিকারী, শিক্ষাব্রতী, প্রজাকল্যাণে তৎপর এবং বাঙলার রেণেসাঁর অন্যতম ব্যক্তিত্ব মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ দেহত্যাগ করেন ১৯১১ সালে।
মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের জীবন একটি শিক্ষা। বিলাসব্যসনে মত্ত না থেকে কিভাবে একটি প্রান্তিক রাজ্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিভাবে হয়ে ওঠা যায় এক বিরাট কর্মকান্ডের পুরোধা সে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি।
তাঁর জীবৎকাল মাত্র পঞ্চাশ বছর। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কর্মকান্ড?
কোন সংখ্যায় পরিমাপ করা যায় না তা....
তথ্য: কোচবিহার রাজবংশ/সুরেন্দ্রমোহন বসু (কোচবিহারের ইতিহাস: ভগবতীচরণ বন্দোপাধ্যায়)
ছবি পরিচিতি: আমার কর্মক্ষেত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রজাবৎসল মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের মর্মর মূর্তি। রাজপরিবার থেকে বিদ্যালয়কে মূর্তিটি উপহার দেওয়া হয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours