স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব শেষ। আমরাও নিজেদের রিচার্জ করে আবার কাজে কম্মে পুরোদস্তুর নেমে পড়েছি। মিডিয়া বেশ খানিকটা পুজোতে টি আর পি বাড়িয়ে নিয়েছে নিজের নিজের মত করে। মা দুর্গা নিজেকে যতটা বেশি কুৎসিত রূপে নিজেকে সামানে এনেছেন , ইন্সটলেশন আর্টের নামে পুরষ্কার জিতেছেন। আর কৌলীন্যের নিরিখে জাতে উঠেছে পুজো কমিটি। আসছে বছর আবার হবে স্লোগান তুলে ,মায়ের রূপ থেকে কতটা দেবী ভাবকে মুছে ফেলা যায়, সেটা নিয়ে সলতে পাকাতে শুরু করে দিয়েছে। এর মাঝে আবার মেগা কারনিভাল।দেড় হাজার বিদেশী নাকি প্রত্যক্ষ করবেন এই মেগা পুজো কার্নিভাল। এর থেকে নাকি অনেক বিদেশী মুদ্রা রাজ্যে অর্জিত হয়েছে, সেটা নিয়েও গলা ফাটিয়েছেন প্রশাসনিক স্তরের অনেকেই।   
সে যাক। পুজো মিটে গেছে। এখন বেশ কয়েকটা কথা বলা যেতেই পারে। এবছর মাথা পিছু দু’হাজার টাকায় গাড়ি করে এই কলকাতার ও আশ পাশের বেশ কিছু বনেদি বাড়ির পুজো দেখানো হয়েছে। সে ভালো। 
আচ্ছা, একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো , এই যে বনেদি নামক তকমা ধারী বাড়ি গুলি আজো দামামা বাজিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের বড়াই করে, তাঁদের সেই আভিজাত্যের ভিত্তিটা কি ছিল, সেটা তাঁরা বলেন কি ?নাকি ফিরে তাকান পিছনের দিকে? 
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কারোর নাম নেব না। তাহলে তাঁদের গায়ে লাগতে পারে। তাই প্রতীকী হিসাবে পরম্পরা ধরছি।
উত্তর কলকাতার একটি পরিবারের পুজো না দেখলে নাকি জীবন ধন্য হয় না। সেই রাজবাড়ির পুজোর ইতিহাস কি? সিরাজদ্দৌল্লার অর্থভান্ডার ব্রিটিশদের সঙ্গে লুন্ঠন করে ,তাঁকে হত্যা করে, ফুর্তির আসর বসাতে, বাইজী নাচ সহযোগে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিল। এই বাড়ির আসল পুজো আজ কৌলীন্যের অন্ধকারে। নকল বাড়ির চাতালে,নাটমন্দিরে আভিজাত্যের গর্ব করে চলছে সেই পুজো।আমরা ,আমাদের পুর্ব পুরুষদের সেই প্রজাসুলভ মনোভাব নিয়ে , সেই দুর্গা আরাধনা দেখতে দৌড়ই। একবারো ভাবিনা, এই পরিবার ব্রিটিশদের বন্ধু ছিল। এদের হাত ধরেই বাংলা চলে গিয়েছিলো ব্রিটিশদের হাuতে।এরা কতটা প্রজাসুলভ ছিল, সেটার কোন ইতিহাস কি লেখা আছে কোথাও? 
এরকম পরিবার এই উত্তর কলকাতায় আছে বহু। আর আছে বাবু কালচারের আভিজাত্যের লড়াই এ সামিল বেশ কিছু পরিবার। এর কেউই ধর্মীয় কারণে মাকে তাঁদের গৃহে আরাধনা করেছিলেন বলে ইতিহাস অন্ততঃ বলে না। পারস্পরিক আভিজাত্যের গরিমার লড়াই, আর সদ্য অর্থের বলে বলিয়ান হয়ে শক্তি মানে দুর্গা আরাধনা করেছেন বহু পরিবার। আরো একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এরা সবাই ছিলেন ইংরেজদের পদলেহন কারি এক একটি পরিবার। সেই সময়ে এই দুর্গা আরাধনায় ইংরেজদের নিমন্ত্রণ করে । কতটা তৈল মর্দন করা যায় , সেই দিকে লক্ষ্য করেই করা হত আয়োজন। একটু পিছিয়ে পড়া পরিবারেরা অবশ্য ব্রিটিশদের আমলা শ্রেণিকে তদ্বির করে সামান্য রায়বাহাদুর উপাধি পাবার লক্ষ্যে এগোতেন এই পুজোর আয়জনকে ঘিরে।
দক্ষিণ কলকাতার একটি পরিবার ব্রিটিশদের দেওয়ান। রাজস্ব আদায়ের অধিকার অর্জন করে তাঁরা জাতে ওঠেন। আর জাতে উঠেই প্রজা সন্তুষ্টির নামে ব্রিটিশ সন্তুষ্টির চেষ্টা করতে থাকেন। সেই পরিবারের পুজো দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সকলে। এদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো তাঁর এলাকার উন্নয়নে তাঁদের ভুমিকা কি ছিল ? আর রাজস্ব আদায়ের নামে, প্রজাদের সঙ্গে তাঁরা কেমন ব্যবহার করতেন তাঁদের পুর্ব পুরুষ ? তাঁদের লেঠেল বাহিনীর জগত জোড়া খ্যাতি কি এমনি এমনি হয়েছিল ?
একবার প্রশ্ন করেছেন কি নিজেকে ? যে ব্রিটিশদের তাড়াবার জন্য হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাণের বলি চড়েছিল ব্রিটিশদের হাড়িকাঠে। সে সব পরিবার ,যাঁদের সরাসরি সহযোগিতা ছিল এই বলির খড়্গ টা শান দিয়ে এগিয়ে দেওয়ার। স্বাধীনোত্তর ভারতে সেই সব তাঁবেদার পরিবার এখন কৌলীন্য পেয়েছে বনেদি পরিবার নামক তকমায়। সামনের বছর এই বাড়িগুলিতে যাবার আগে , এদের আগের পরিচয় জেনে ,দেবীকে দেখতে যান। কেন এটা বললাম, আমার প্রিয় জনের রক্তের ওপর দিয়েই এদের চৌকাঠ পেরোতে হবে। আর সাথ দিতে হবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে থাকা বীর সন্তানদের হত্যাকারিদের সহায়কদের।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours