স্বপন সেন, ফিচার রাইটার, হালিশহর:

২৬ নভেম্বর ১৯৭৫, সকাল প্রায় ৯টা। ধানমণ্ডি দুই নাম্বার রোড, গাছপালায় ঢাকা নিস্তব্ধ এক আবাসিক এলাকা। এখন যেখানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঠিক সেখানেই ছিল সেসময় ভারতীয় দূতাবাস। বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক দলের বিশেষ বাহিনীর তিনজন পজিশন নিল রাস্তার ডান পাশে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাছে, আর অন্য তিনজন ‍অপেক্ষা করতে থাকে ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। তাদের কাছে খবর ছিল প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অফিসে আসেন। সেদিন সকাল ৯টা বেজে ৪০ মিনিটে তাঁর গাড়ি এসে দাঁড়ায় দূতাবাসের সদর দরজায়, নেমে এলেন বাঙালি রাষ্ট্রদূত। গাড়ি থেকে নামতেই  ছয় তরুণের দলটি  তাঁকে ঘিরে ধরে। পিস্তল উঁচিয়ে বলে ‘আপনি এখন আমাদের হাতে বন্দী, আপনার সাথে আমাদের কথা আছে।’ 

স্বাভাবিকভাবেই হাইকমিশনার সাহেব বিস্মিত হলেও বুদ্ধি হারান নি। কথা বলে তাদের কিছুটা ব্যস্ত করে রাখলেন । এদিকে অপারেশনের  আগে যারা রেকি করেছিল, তারা কিন্তু খেয়াল করেনি ভবনের দোতলায় ITBP কম্যান্ডোদের একটি দল অতন্দ্র পাহারায় থাকে। ফলে যখন তারা ওনাকে অপেক্ষমান গাড়িতে তুলতে যায়, তখনই উপর থেকে শুরু হয় ব্রাশফায়ার। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবাই।

অপহরণকারীদের মধ্যে তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। দুজন আহত হয়ে  কাতরাতে থাকে। রাজদূতের কাঁধেও গুলি লাগে, তবে আঘাত ততটা মারাত্মক ছিল না। খবর পেয়ে তখুনি ঘটনাস্থলে আসেন নবনিযুক্ত সেনা প্রধান,
ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর। তিনি আহত রাজদূতকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান। আহত ও মৃত অপহরণ কারীদের পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ। এদিন প্রিয় বন্ধু কবি আবুল হাসানের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি যখন হাসপাতালের গেটে পৌঁছান, তখন একদল পুলিশ এসে পিজি হাসপাতাল ঘিরে ফেলে। পুলিশ কর্ডন করা অবস্থায় একটি কালো মার্সিডিস গাড়ি খুব দ্রুত পিজি হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে।

নির্মলেন্দু গুণের কথায়, ‘আমি হাসপাতালে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখতে পাই, উর্দিধারীরা এক ভদ্রলোককে  ধরাধরি করে হাসপাতালের রিসেপশনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, উনি হচ্ছেন ভারতীয় হাইকমিশনার। তার দেহ ছিল রক্তাক্ত, গায়ে শুধু গেঞ্জি ছিল। তিনি বাম হাতে ডান কাঁধের দিকে একটি ক্ষতস্থানকে চেপে ধরে খুবই ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে নার্স ও ডাক্তাররা ছুটে আসে। এরপর কি হলো জানা নেই।'

খবর শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি ওনাকে উদ্ধার করে আনবার জন্য বিমানবাহিনীর একটি কম্যান্ডো দলকে তৈরি হতে বলেন। কিন্তু রাজী হননি ঐ বঙ্গসন্তান, ইন্দিরাজীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বাংলাদেশী ডাক্তার ও প্রশাসনের ওপর তার যথেষ্ট আস্থা আছে। শেষমেশ ইন্দিরা ওনার শারীরিক অবস্থা তদারকির জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কে ঢাকায় পাঠান। কে এই কূটনীতিক?

১৯৩৭ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে আইসিএস অফিসার হিসাবে বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দেন এই বঙ্গসন্তান । ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন সরকারী কর্মকর্তা রূপে। দেশ স্বাধীন হবার পর ফরেন সার্ভিসে নিযুক্ত হন । সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ ছাড়াও মরক্কো, আলজেরিয়া, লেবানন, কুয়েত, জর্দান, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও সুইডেনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি । সেসময় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি হয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ ১২ জন জাতি সংঘের ২৬ তম সাধারণ সভায় যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে আসেন। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ তখন জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্র নয় তাই অফিসিয়াল কর্মকান্ডে তাদের যোগ দিতে দেয়া হয়নি। ৩রা ডিসেম্বর, যে দিন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন বিচারপতি চৌধুরী লিখিত আবেদন করেন যাতে বাংলাদেশের অবস্থা সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যদের সামনে তুলে ধরতে পারেন। পাকিস্তান ও তার দোসর আমেরিকা, চীন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশ গুলোর চাপে বিচারপতি চৌধুরীকে কিছু বলার অনুমতি দেয়া হয়না। এই ভারতীয় কূটনীতিক তখন বলেন, "বাংলাদেশকে কিছু বলতে না দেওয়ার মানে হচ্ছে ডেনমার্কের রাজকুমার ছাড়া হ্যামলেট নাটক দেখার মত।"

জাতিসঙ্ঘে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যে রাশিয়া ও পোলান্ড বাদে অন্য অধিকাংশ দেশ যেমন আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ সব মুসলিম দেশ ও পশ্চিমা দুনিয়া প্রায় এক সুরে কথা বলছে তখন সিকিউরিটি কাউন্সেলে ইনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন:
"None can remove us from our path by mere resolutions and mere exhorttations. The question of a cease-fire, as I have already mentioned, is one not between India and Pakistan, but between the Pakistan Army and the Bangladeshi people. Therefore, let us hear them before we go further into this debate."

তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। পূর্বসূরি সুবিমল দত্তের মতো তারও জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা পূর্ববাংলার মাটিতে ।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫, বিশেষ কাজে ছিলেন দিল্লীতে। মুজিব হত্যার খবর পেয়ে তখনি ছুটে আসেন ঢাকাতে। প্লেন চলাচল বন্ধ ছিল তাই কোলকাতা থেকে গাড়ীতে পরদিনই ঢাকা ফেরেন।

সেসময় ক্ষমতাসীন মুশতাক ও তার দলবল পরিকল্পনা করছিল বাংলাদেশের নাম 'গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'-এর বদলে 'ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' করা হবে।

১৮ই আগষ্ট তিনি সোজা বঙ্গভবনে গিয়ে খোন্দকার মুশতাকের সাথে দেখা করে ভারত সরকারের সতর্কবানী জানিয়ে দেন। পরিস্কার বলেন যদি বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয়, বা বাংলাদেশ অন্য কোন দেশের সাথে কনফেডারেশন করে তবে চুক্তি অনুসারে ভারতীয় সেনা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করবে। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থান দেখে মুশতাক পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

এই ঘটনার প্রায় তিন মাস পর তিনি অপহরণ প্রচেষ্টার শিকার হন। তবে এনিয়ে জীবদ্দশায় তিনি আর মুখ খোলেননি। কর্মজীবনের শেষদিকে তাকে  বিদেশ সচিব করার প্রস্তাব দেয়া হয়, কিন্তু  সরকারের বিদেশ নীতি পছন্দ না হওয়ায় তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের বিদেশ মন্ত্রালয়ের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা।  
২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সফল এই বাঙালি কূটনীতিক।
ওহো, এতক্ষণ তো নামটাই বলা হয়নি । তিনি আর কেউ নন ............. ...সেন বংশের এক সিংহ পুরুষ শ্রী সমর সেন ! স্মৃতিচারণার মাধ্যমে জানাই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ‌


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours