রুদ্র সান্যাল, লেখক, শিলিগুড়ি:

তখন বয়েস আর কত হবে, বড়জোর চার কি পাঁচ। সেই সময় বাবা একদিন একটা ছোটদের বই কিনে নিয়ে এলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ছোটদের আনন্দমেলা। ছোট সাইজের বই, এখনকার মতন বড় দেখতে নয়। তার ভিতরে প্রথম দেখতে পেলাম টিনটিনের কমিক্স। সাথে গাবলু। সেই অতটুকু বয়েসে টিনটিনের সেই সব মোহময়ী এডভেঞ্চারের কাহিনীর প্রেমে পড়ে গেলাম। নতুন একটা জগতের দ্বার উন্মুক্ত হলো মনের মণিকোঠায়। একের পর এক টিনটিনের গল্প গোগ্রাসে গিলতে থাকতাম। আর ওই অপেক্ষায় আনন্দমেলার ভক্ত হয়ে উঠলাম। সেই সময় টিনটিনের গল্পের অনুবাদ করার কৃতিত্ব ছিল স্বয়ং সম্পাদক মশাই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। পরবর্তী কালে যা পৌলমী সেনগুপ্তের নিজের অনবদ্য অনুবাদে আরো পরিশীলিত হয়েছিল। একদিকে টিনটিন নিজে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। অন্যদিকে তার কুকুর কুট্টুস বা স্নোয়ি। অপরদিকে ক্যালকুলাসের মত কানে কম শোনা অসামান্য বৈজ্ঞানিক। আবার জনসন রনসনের মতো মানিকজোর গোয়েন্দা। আবার বিয়ানকা ক্যাস্স্টাফিয়ারের মতন গায়িকা।সবদিক থেকেই ছেলে বুড়ো সবার জন্যই জমজমাট ছিল সেই সব কমিক্স।

বেলজিয়াম মূলত বিখ্যাত তার চকোলেট, এবং গ্লাস বা আয়নার জন্যে। কিন্তু এর বাইরে সারা পৃথিবীর সামনে দেশটি কে বিশেষ ভাবে পরিচিত করান, কার্টুনিস্ট হার্জে যার আসল নাম ছিল জর্জেস রেমি। টিনটিন কে জগৎ বিখ্যাত করার কারিগর। আসলে হার্জেই ছিলেন টিনটিনের সর্ষ্টিকর্তা। এই কমিক বানানোর সময় তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে সারা পৃথিবীতে এতটা জনপ্রিয় হবে, তার এই পছন্দের চরিত্র। সত্তরের দশকে আনন্দমেলা নামক ছোটদের ম্যাগাজিনে বাংলায় অনুবাদ করে তাকে আমাদের মতো সেই সময় কার অল্পবয়সী পাঠকদের কাছে চূড়ান্ত ভাবে জনপ্রিয় করার কারিগর ছিলেন আনন্দমেলার সম্পাদক প্রখ্যাত সাহিত্যিক তথা কবি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্বয়ং। সেই ১৯২৬ সাল থেকে টিনটিনের ভ্রমণ কাহিনী শুরু হয়। এরপর ১৯৩৪ সালের পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে টিনটিনের কমিক্স বেরোতে থাকে একের পর এক। তার জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে সারা বিশ্বজুড়ে। হ্যাডকের মতো বদরাগী অথচ মজার সঙ্গী কে নিয়ে একের পর এক অভিযান করতে থাকে টিনটিন। সেই সব গল্প সেই ছোটবেলার মন কে উদ্বেলিত করতো একটা সময়। বাঙালি শিশু কিশোর কে টিনটিনের প্রতি ভালোবাসার জন্যে   সম্পূর্ন কৃতিত্ব আনন্দমেলার।

টিনটিনের পরে আনন্দমেলায় প্রকাশিত হয় আস্টিরিক্স এবং ওবেলিক্স এর কমিক্স। এই দুজনে মিলে বেশ কিছু অসামান্য অভিযান করে। তাদের গল দেশের সাথে রোমান দের ঝামেলা নিয়ে প্রচুর মজার মজার অভিযান দেখা যায়। গোসিনি এবং ইউদেরজো তৈরি করা এই ফরাসি কমিক্স কেও বাংলায় জনপ্রিয় করেন পৌলমি সেনগুপ্ত।  শিশু কিশোর দের কাছে ও এক অসামান্য পাওনা।

সেই সাতের দশকের শেষ এবং আটের দশকের গোড়ায় যখন টেলিভিশন হীন বাঙালি শৈশব এবং কৈশোরের প্রাকরম্ভে আনন্দমেলায় টিনটিন যেভাবে উদ্বেলিত করতো মন টাকে, সেই সময় হঠাৎ করে হাতে পেলাম শুকতারা আর কিশোরভারতী, সেখানেই প্রথম পরিচয় নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে কেল্টুদা, বাঁটুল দি গ্রেট, এই ধরণের কমিক্স গুলোর চরিত্ররা ছিল সম্পুর্ন বাঙালিয়ানার স্বাদে তৈরি। একেবারে নিজের প্রতিবেশী ছেলে গুলোর চরিত্র ছিল তারা। যেভাবে বাঁটুল দুষ্টের দমন করতো, বা কেল্টু দা কে হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট স্যার শায়েস্তা করতো, সেগুলো দেখলে সেই সময়  এক অদ্ভুত অনাবিল হাসি এবং মজা লাগতো। যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ইন্টারনেট বা কার্টুন হীন জীবনে এরাই ছিল আমাদের সেই সময়ের একমাত্র শিশু সুলভ অবলম্বন। এক নিষ্পাপ আনন্দের উপাদান।

সেই আটের দশকেই আর একটি সর্বভারতীয় কমিক্স ও ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে তা হলো চাচা চৌধুরী আর সাবুর কান্ডকারখানা। যা সেই সময় শিশু মন কে যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছিল।

তখন ময়ূখ চৌধুরীর কমিক্স ও দেখা যেতো মাঝে মাঝেই। একটু অন্যরকম হলেও খারাপ লাগতো না। ক্লাস টু কিংবা থ্রির সময় হঠাৎ করে হাতে পেলাম ইন্দ্রজাল কমিক্স। তাতেই প্রথম দেখতে পাওয়া গেল, বেতাল বা অরণ্যদেব যাকে আফ্রিকার জঙ্গলের প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী বলা হতো 'চলমান অশরীরী'। অরণ্যদেবের মুখের সেই অদ্ভুত মুখোশ এক অন্যরকম কল্পনার স্বাদ এনে দিতো সেই শিশু মনে। তার সুন্দরী অভিজাত স্ত্রী ডায়ানা পামার।  সেই অল্প বয়সে অরণ্যদেবের কমিক্স পড়া, বাড়ির বড়রা মোটেও খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাও অন্যের বাড়িতে বা বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে পড়া হতো সেই সময়। যদিও সেই অল্প বয়সে অরণ্য দেবের কমিক্স থেকেই রাষ্ট্র সংঘ বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর সম্মন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। এরপর এলো জাদুকর ম্যানড্রেকের কাহিনী নিয়ে কমিক্স পড়া। সেও এক অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা। তখন আনন্দবাজারের প্রথম পাতার পিছনে অরণ্যদেব এবং ম্যানড্রেকের কমিক্সের স্ট্রিপ থাকতো। সেই বয়েসে ওই স্ট্রিপ কেটে খাতায় লাগিয়ে কমিক্সের বই বানানোর অক্ষম চেষ্টা সেই নব্য কৈশোর মন কে বেশ ভালভাবেই উদ্বেলিত করতো। যদিও বড়দের চোখরাঙানির ভয়ে সেই সব কাজ অসুমপূর্ণই থেকে গেল। এছাড়া ফ্ল্যাশ গর্ডন এর স্টার ট্রেক ঘরানার কমিক্স ও সময় কাটানোর জন্য বেশ ভালো ছিল। মহাকাশ কল্পবিজ্ঞানের অনেক কিছু জানা যেত সেখানে। আর আমাদের একেবারে ভারতীয় কমিক্স বাহাদুরের জারিজুরি নিয়েও বেশ কিছু কমিক্স ছিল। সেই সময়কার শিশু কিশোর দের কাছে এই কমিক্স গুলো ছিল অমূল্য।

নব্বুইয়ের দশকের গোড়ার দিকেই হটাৎ করে ইন্দ্রজাল কমিক্স গুলি কেমন ভাবে যেন, মিলিয়ে গেল বাতাসে,আর সহজ লভ্য হলো না আমাদের কাছে। এরপর কেবল টিভি আর মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে কমিক্স পড়া ক্রমশ বন্ধ হতে লাগলো শিশু এবং  কিশোর দের। এখন পোকিমন এর যুগে কমিক্স ক্রমশ শিশু পাঠ্যের থেকে বিদায় নিয়েছে। বই পড়ার অভ্যাস টাও ক্রমশ মৃতপ্রায়। তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে, পড়াশোনার চাপে কমিক্স পড়াটাও এখন একপ্রকার বাতুলতা মাত্র। সেই সময় কার কাহিনী এবং অঙ্কন দিয়ে কমিক্সের কল্পনার জগৎ কেবল ছিল সাত কিংবা আটের দশকের শিশু কিশোরদের কাছে কল্পনার এক স্বপ্নের খনি, যা এখন আশা করাটাই অন্যায়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours