নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া

সেই যে একদিন মধ্যরাতের স্বপ্নের ঘুড়ি কেটে গেল হৃদয়ে মারাত্মক আহত হল প্রাণ, সেই থেকে ভেসে বেড়াচ্ছি শূন্যে ...... বুকের মধ্যে অচিন পাখি এক করুণ স্বর, কাঁদে নিভৃতে।
সেদিন শেষ বিকালের লালচে আলোর খেলা চলছে দিগন্তে। নতুন আরেকটি সন্ধ্যার আগমনী সংকেত বাজছে। কেন যেন পুরোনো মানুষদের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো। ক্লিনিকের বেডে শুয়ে বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম আমার হাসব্যন্ডকে , আচ্ছা বলতো, বাবু দেখতে কার মতো হয়েছে ? ও বলতো তোমার মতো , পুরোটাই তুমি , আবার জিজ্ঞেস করতাম , আচ্ছা বলোতো, ওর নাক চোখ মুখ দেখতে  কেমন হয়েছে ? ও আবার বলতো , আরে বাবা বললাম তো , নাক তো তোমার মতো উঁচু লম্বা , ভ্রু গুলোও তোমার মতো ।
ইসস! কি স্বর্গীয় কি স্বর্গীয় অনুভূতি ! আমরা দুজন থেকে তিন জন । ভাবতেই মনে একটা নরম পুলক । অচেনা আনন্দে বুকের ভেতরটা ফিঙের মতো নেচে উঠতো । বাবুটাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে হাসপাতালে, সি সেকশন করে হয়েছে ও স্বভাবতই আমি সিক তাই ক্লিনিকে ।
নাজমীন মর্তুজা
ওর সামান্য ঠাণ্ডা এবং একটু সময়ের আগে হওয়াতে কাছেই হাসপাতাল সেখানে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে , শিশু ডাক্তারের পরামর্শে । আমার মা আছেন ওর সাথে । বাবুর বাবা আসা যাওয়া করছে ঘন্টায় ঘন্টায় , একবার আমার কাছে , তো একবার বাবুর কাছে।
আমি তো নিশ্চিন্ত , বাবুর বাবা ডাক্তার , অগাধ আস্থা আমার , এই তো ও বলছে ৭২ ঘন্টা পর বাবুকে আমার কোলে দেবে । বিয়ের দীর্ঘ ১০ বছর অপেক্ষার পর ও এসেছে আমার কোলে !  আনন্দের কোন সীমা নেই । সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে ,খুব চুপচাপ রুমটা , অপেক্ষায় আছি , বাবুর বাবা আসার ,দরজায় চোখ পেতে রেখেছি , নিজ হাতে বানানো জামা। জুতো , ন্যাপি ওকে পরাবো।
প্রতিটা মিনিট অপেক্ষা করি , বাবুকে দেখে আসার পর ওর গল্প শোনার । একসময় হাসপাতাল থেকে , আম্মা চাচী বাবুর বাবা সবাই ফিরে এলো , আমি ভাবলাম বাবুকে এনেছে । আমাকে কোলে দেবে । মিথ্যে বলছে সবাই । বলেছে ও ঘুমাচ্ছে মেশিনের ভেতরে তাই , আমাদের ডাক্তার বললো ওর মায়ের কাছে যেতে। এক এক জন মানুষ কতটা অভিনয় পটু , আমি বুঝতেই পারিনি , আমাকে মিথ্যে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাডা়নোর পায়তারা করছে সব্বাই । ইসস! ওরা কি একবারও ভাবেনি কি করে একজন মা , মৃত সন্তানের সাজানো লাশের পাশে ধুপ কর্পুরের গন্ধ মেখে ঘুমাতে পারে!
আজ এতোটা বছর পর বিদেশের মাটিতে ভাবছি কি করে টুপটাপ ঝড়ে গেছে চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো। আজ যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছি ,  মনে হচ্ছে রাস্তাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো কখনো।
উফ! মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু যে কী কষ্টের তা আমি জানি। গর্ভধারণের পর থেকে ভূমিষ্ট পর্যন্ত তিল তিল করে ভ্রুণ বেড়ে ওঠার সাথে , একজন মায়ের স্বপ্ন গুলোও তিল তিল করে জমা হয় । ২০০৫ সালে শুধু মৃত ছেলের শরীরটা একটু ছুঁয়ে দেখেছিলাম। সেই ছোঁয়ার অনুভব এখনো স্পষ্ট। ‘গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহে নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখে। আর আমার ছিল ৩৬ সপ্তাহ। এক সপ্তাহ আগেই সে হয়ত আমার ঠোঁটের স্পর্শ পেতে চলে এসেছিল ।
মা ও সন্তানের স্নেহের কাছে অন্য সব স্নেহ ভালোবাসা  যে আদতে কতটা ফিকে, তা আমি টের পাই পলে পলে । বুকে পাথর বেঁধে সন্তানের লাশ নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম সেদিন , পুরো পথটা হাসপাতাল থেকে বাড়ি , ওর হাতের আঙুল গুলো আমার দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে রেখেছিলাম , বুঝতে পারছিলাম ও আমাকে কত কি বলতে চাইতো , কত আদর করতে চাইতো। শিশুর মুখে বারবার চুমু খাচ্ছিলাম পাগলের মতো।
ভাবছিলাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কখনো ভাবিনি আর কোনো দিন জেগে উঠবে না বুকের মানিক। সন্তানের পরশ মাখা আঙুল কখনো লাগবে না আর আমার  গালে। কখনো মিটিমিটি হাসবে না ভালোবাসার ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে। কাঁদবে না আর। ভাবতেই পারিনি একবিন্দু , কেমন জানি অবশ হয়ে যাওয়া সেই সময়ের অনুভূতি । কঠিন হলেও নির্মম এ সত্য আমাকে মেনে নিতে হয়েছে, সন্তানের মুখে শেষ চুম্বনের মাধ্যমে।
কী করে সহ্য করে মা, সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু! যার হয় এমন সত্যের সামনা সেই কেবল বুঝতে পারে রক্তক্ষরণের ব্যথা।
আমাকে বেশুমার যারা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, আমি তাদের কাছে বায়নার মতো কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম , এনে দাও আমার বাবুটাকে ! আব্বা .. আম্মা ... আমার বাবুটাকে এনে দাও। কেউ কি আর পারে , এমন বায়না মিটাতে? পারে মায়ের শূণ্য কোল পূরণ করতে? পারে কি ফিরিয়ে দিতে সন্তানের সুখ ? ফিরিয়ে দিতে পারে না কোন আপনজনই । শুধু নীরবে চোখ মুছে কষ্টে পাথর হয়েছিলাম সেদিন । ভুলতে পারেননি আজও সন্তানের ভালোবাসা আর স্মৃতিগুলো , পেটের ভেতরে নড়ে চড়ে জানান দেওয়া , নিজ হাতে ওর জন্য  মোজা বুনেছিলাম , নক্সীকাঁথা, ন্যাপি।
সন্তান হারানোর গমকে গমকে কান্নার ঢেউ তো কেউ  বুঝে না, কেবল একটি মায়ের আত্মাই আহাজারি করে , যদিও জীবন চলে নিজ গতিতে। সেদিনের সেই আহত পাখির মতো আমার হৃদয়ের ক্ষত এখনো দগদগে , থেমে থেমে কাঁন্না , আদর করেছি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে । আমার কান্নায় সেদিন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চোখে টলমল পানি দেখেছি সবার।
চোখের সামনে বুকের ধন, আদরের বাতিঘরের মৃত্যু কি পারে  ভুলতে একজন হতভাগা মা! অন্যরকম কষ্টকর স্মৃতির একটি চিত্র, চোখের পানি মুছতে মুছতে ওকে মাটি চাপা দিয়ে পাড়ি দিয়ে এসেছি অচেনা পথে।
কোনদিন ভাবতেই পারিনি ভূলে চোখের জলেই হবে তার চির বিদায়,  হাউমাউ করে কেঁদে উঠেও আমার কষ্ট লাঘব হয় না কিছুতেই। নিষ্প্রাণ, বোধশূন্য, হয়ে যাই এই দিনটা আসলেই । হিলিয়াম বেলুন ছেড়ে দেই আকাশে ওর নামে । দূরে দূরে যত দূরে যায় বেলুন গুলো আমার দৃষ্টির সীমানা ভেদ করে , আমি ততই ভাবী এই তো চলে গেল বাবুর কাছে।
আমার আদর গুলো নিয়ে । আকাশের কাছে জানতে চাইলে জবাব আসে—কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালার মতো অন্ধকার হয়ে  চারদিক!  তোমার বাবুকে খুঁজে পাইনি আকাশে ! আমি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠি । পার্কের গাছ জড়িয়ে কাঁদি , ঘাসের গালিচায় গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদি । মাটির উপরে হাত বুলিয়ে বলি , মাটি তুমিই ওকে তোমার বুকে রেখেছো জানি !
বাস্তবতার কঠিন দুনিয়ায় চারপাশটা কেবলই ফাঁকি আর মমতার ফাঁদ! মন তখন খুঁজে বেড়ায় একটা আশ্বাস—আশ্রয়, নির্ভরতা আর শুশ্রূষা সন্তানের কাছে মায়ের , আর মায়ের কাছে সন্তানের।
বুকের ভেতর থেকে  ভাপরের বাতাস ঠেলে বের হতে চায় , গরম নিঃশ্বাস ওঠে। চোখের পানি আড়াল করতেই চাই , পারি না , মেয়ে দুটো বলে মা তুমি ভাইয়ার জন্য কাঁদছো?
কখনো কখনো গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন ছেলেটার  মুখ মনে পড়ে; কিন্তু মনে করতে চাই না! তবুও জোর করেই মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনা উঁকি দেয়। মনে হয় ওর কবরের পাশে গিয়ে শুয়ে থাকি , ও নিশ্চয় রায়া রুহার মতো আমাকে জড়িয়ে ঘুমোতে চাইছে । শুধু অপেক্ষায় থাকি ও হয়ত আসবে , রায়া রুহার সাথে খেলবে , ওর বয়সী বাবুদের কে দেখলে মনে হয় ইসস এখন এমন হতো , এতোটা বেড়ে উঠতো , গোঁফের আঁকড় বসতো মুখে ।
ভাবি হঠাৎ করেই একদিন সে আমার সামনে আসবে! আমি শক্ত করে বুকে জড়িয়ে সেদিন অভিমানের সুরে কেঁদে কেঁদে বলবো , কোথায় গিয়েছিলে বাবাটা আমার হৃদপিণ্ডের ধুকপুক ।মা কে ফেলে আর যাবে না , কিন্তু!
দুদিনের দুনিয়ায় স্বার্থের জুয়াখেলায় মত্ত এই বিচিত্র পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে -জীবনের জন্য ধ্রুব মৃত্যুর কথাটাই ভুলে গেছি।
সামনে দিয়ে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে গেলেও মনে হয় না মরব। অথচ ঠিক আগামী কালই আমাদের সবাইকে নিম্ন মানের সেলাই বিহীন কাপড় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এর পরও মানুষ পিতা-মাতার খোঁজ-খবর রাখে না, মিথ্যা বলে কিংবা ঘুষ খায়। বিনা দোষে মায়ের কোল খালি করে দেয় । খুন করে । কিন্তু একটা জীবনের মূল্য তখনি বোঝা যায় , যখন প্রাণ বাতি থাকে না , নিজের মানুষটাকে ডাকলে পাওয়া যায় না । এই শূন্যতা কিছুতেই কিছু দিয়ে ভরে না।
এই টুকু বলি শুধু চোখের সামনে না থাকুক, তবুও আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
শুধু চাইবো আমার মতো আর যেন কোন মায়েদের মুখে টেনে দেওয়া  সন্তান হারানোর আতঙ্কের আঁচলে মুখ ঢেকে না কাঁদে কেউ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours