গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মের  রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম রেষারেষি এই সব নিয়ে যখন সারা দেশ তোলপাড়, তখন একটু অন্যরকম মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প শুনলে কেমন হয় :- যখন হিন্দুর দুর্গাপুজো হয়ে যায় সম্প্রীতির মেলবন্ধনে সবার শারদীয়া উৎসব, হয়ে ওঠে সম্পূর্ণা...                  গ্রাম দিয়ে শুরু করি, মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ ব্লকের বৈদরা গ্রাম, ছোট্ট জনপদ, প্রত্যন্ত গ্রাম বললে ভুল হবে না, এই গ্রামেরই হিন্দু-মুসলিমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই একসঙ্গে প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন চক্রবর্তীদের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করে আসছে, এটাই ওদের পরম্পরা, সেখানে আজও  শুধু এই হিন্দু পরিবার নয়  মুসলিম পরিবারও একসাথে পুজোর বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করে।
প্রায় চারশো বছর আগে প্রথম এই পুজোর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন জমিদার, আর এখনও আগের মতোই সব রীতি নীতি মেনেই এই পুজো হয়। এই গ্রামে বরাবরই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের একসাথে বসবাস, দুর্গাপুজোর কাজেও হিন্দুদের সাথে একসাথে অংশ নেয় গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে পুজোর আয়োজনের বিভিন্ন কাজ, আরতি সবেতেই হিন্দু-মুসলিমরা পুজোর চার দিন মিলে মিশে অংশগ্রহণ করে, এমনকি বিসর্জনে প্রতিমা নিয়ে যেতে কাঁধও লাগান মুসলমানরা, তারপর বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা জমিদার বাড়িতে চলে আসে, জমিদার বাড়ির তরফ থেকেও গ্রামের সব মুসলমান পরিবারে লুচি ও ফল পাঠানো হয়। জমিদার পরিবারের বর্তমান সদস্যরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর সময়ে সবাই গ্রামের বাড়িতে একত্রিত হয়। অবাক হচ্ছেন ভাবছেন গ্রামের বোকা লোকজনের কান্ড!! তাহলে এবার শহরে আসি একটু 
যেখানে দুর্গাপূজা সার্থক করে সংখ্যালঘু মুসলিমরা, 'বেলগাছিয়ার আমন কমিটি' তিন দশক ধরে দুর্গাপুজোর চার-পাঁচটা দিন অসম্ভব পারদর্শিতায় এবং আন্তরিক ভাবে পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলেছে।    কলকাতার দুর্গাপুজোয়  লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে রাস্তায়, পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, মুসলমান অধ্যুষিত বেলগাছিয়া অঞ্চলের ‘আমন কমিটি' দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে এলাকায় পুজোর ভিড় সামলাতে বা যান নিয়ন্ত্রণের কাজ করে আসছে কিন্তু বহু যুগ ধরে। এই আমন কমিটির পরিচালনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় টালা থেকে শুরু করে বেলগাছিয়া পর্যন্ত কম করে দশ-বারোটি বড় মাপের বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উপচে পড়া ভিড় সামলায়, পুজোয় সময় যখন লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীরা ভোর থেকে  রাত পর্যন্ত মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করতে ব্যস্ত থাকে, তখন নিঃশব্দে তাঁদের গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন এঁরাই, পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুজোর যানজট নিয়ন্ত্রণ, ভিড় সামলানো এমনকি ইভটিজিং রুখতেও এই আমন কমিটির স্বেচ্ছা-সেবকরাই এলাকার প্রধান ভরসা৷ প্রায় তিন দশক ধরে এই মহান সম্প্রতির কাজই তাঁদের মুল পরিচয় হয়ে উঠেছে৷   
'আমন' মানে শান্তি, সারা দেশে জুড়ে যখন মানুষের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতাদের অসহিষ্ণু আচরণে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তখন তিন দশক ধরে 'আমন কমিটি' অসাধারণ ভাবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির বার্তা আর প্রকৃত শান্তির বার্তা রাখছে আসুন সবাই মিলে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours