গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

এই সভ্য সমাজে, বিশেষত চাকরির জগতে নিয়মিত আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় কতো রকমের মানুষ, রোগা, মোটা, বেঁটে, লম্বা, কালো, ফর্সা কতো রকমের বিচিত্র চেহারার নানান পদাধিকারী মানুষ! এদের বাইরের চেহারা নাহয় আমরা সহজেই দেখতে পাই, কিন্তু এদের মনের চেহারা দেখবার কোন উপায় নেই, ছোবল খাবার আগে বোঝা একদম অসম্ভব !!! এদের চোখমুখ দিব্যি মফস্বল বা গ্রাম থেকে আসা ভালোমানুষের মতোই, অতীব ভদ্র, নিরীহ, দেখে ঘূণাক্ষরেও মনে হবে না যে তারা এক-একটা যন্ত্র বিশেষ, এক-এক পিস্  অজগর সাপ, ধীরে ধীরে শরীরের মাপ নেওয়া শেষ হলেই কখন যে গিলে খেয়ে নেবে কেউ বুঝতেও পারবে না। এদের সবারই স্টাইল মোটামুটি ভাবে এক:- "এই চলে যাচ্ছে ভাই কোনো রকমে"..... কিম্বা:- "আমি ভাই কারুর সাতে-পাঁচে নেই, নিরীহ সাদাসিধে মানুষ".... অথচ এরা কিন্তু সর্ব ঘটেই আছেন কাঁঠালি কলার মতো ঘোট পাঁকাতে! একটা কাজ এরা খুব মন দিয়ে করে থাকে, কান খাড়া করে চারদিকের খবর জোগাড় করা! তারপর ইচ্ছেমতো রং মিশিয়ে ঠিক জায়গা মতো গল্পের ছলে ছেড়ে দিয়ে কেল্লা ফতে করা, মানে নিজের কাজ হাসিল করতে এদের জুড়ি মেলা ভার! বহালতবিয়াতেই এরা  বেঁচে আছেন পরনিন্দা পরচর্চা কে ফুল টাইম প্রফেশন বানিয়ে!              এদের চিনবেন কি করে? মোটামুটি এরা সচরাচর খুব একটা ভালো পোশাক-আশাক পরে না, এও এক ধরনের ক্যামোফ্লেজ, নিজের পাপের টাকা বা সাম্রাজ্যকে লুকিয়ে রাখার একটা অমোঘ কৌশল! ইচ্ছে করে যতো রদ্দি জামা কাপড় পরে সস্তা সেন্টিমেন্ট কুড়িয়ে বেড়ায়! ফ্রিতে জুতোর কালি, দাঁদের মলম যা পাবে খেয়ে নেবে! খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায় এরা সব হজম করে ফেলতে পারে এন্টাসিড ছাড়াই! ভালো খদ্দের পেলে তার পয়সায় প্রথমে কোল্ড ড্রিঙ্কস তারপর গরম চা পরমুহূর্তেই ঘন লস্যি খেয়ে  অবলীলায় হজম করে ফেলতে পারে! এদের অফিসের ব্যাগের চেন অফিস ছুটি না হওয়া পর্যন্ত খোলা ই থাকে, কারণটা সহজেই অনুমেয় যা পাওয়া যায় আর কি!! ...এদের হাবভাব সব সময় বিধ্বস্ত, কন্সটিপেশন রোগির মতো মুখ যেন "খুব চাপ ভাই" গোছের মুখ, মনে হবে সদ্য অফিস টাইমের বোঁনগা বা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল থেকে যেন নামল!
বেসিকালি সব বিষয়ে এদের অগাধ পাণ্ডিত্য, ক্রিকেট থেকে সিনেমা, অর্থনীতি থেকে রাজনীতি সবেতেই অবাধ যাতায়াত, দায়িত্ব পেলে পৃথিবীর জটিলতর সমস্যা গুলোর সমাধান করে ফেলতে পারে চুটকি বাজিয়ে, অথচ এদের টেবিলে ফাইলের পাহাড় মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে! কোনো কাজ এক চুলও এগোতে পারে না এদের জ্বালায়, নোটের পর নোট লিখে ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরে বেড়ায় এদের কেরামতিতে, এরা কিন্তু আবার খুউব "নীতিপরায়ণ"! অন্যর সামান্য ভুল এদের চোখে নিমেষে ধরা পড়ে! অফিসে ঢুকেই শুরু হয়ে যায় নতুন নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা "আমাজনে লেলিহান আগুন কিম্বা কাশ্মীরে সরকারের অত্যাচার, সারদা বা নারদা কেলেঙ্কারি",  মুনমুন সেন থেকে শুরু করে রাখি শাবন্তের ক্যারেকটার ভাল খারাপ দিক, কখনও বিরাট কোহলির ক্যাপ্টেন্সির টেকনিক্যাল ভুল খুঁজে বের করা কিম্বা জিডিপির গ্রোথ কমে যাওয়াতে পটলের দাম বেড়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি, তবে একটা ভালো গুনের অধিকারী এরা, সবাই প্রায় রবি ঠাকুরের ভক্ত! এক নিমেষে বাইফোকাল চশমা দিয়ে দূরের পৃথিবীর যেকোনো সমস্যার আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলতে পারে এরা অনায়াসে। দালালিটাও এরা করে চমৎকার, মওকা বুঝে যখন তখন টিম বদলায়, রং বদলে ফেলতে পারে এক মূহুর্তে, মাঝে-মাঝে এদের মন আবার একটু আধটু বিদ্রোহ করে ওঠে, তাই ফ্রি তে মদ্যপান করে ফেলে চুপি চুপি বৌ কে লুকিয়ে, চাদরে মুখ ঢেকে! এদের অনেকেরই শরীরের ভেতরে ছটপট করে অতৃপ্ত সুপ্ত কামনা বাসনার উত্তেজনা, সেই উত্তেজনা প্রশমিত করতে যখন তখন পাশের মহিলা সহকর্মীকে শুনিয়ে শুনিয়ে চটুল ভালগার আলোচনা করার বিষয়েও এরা মাস্টার!
কিন্তু মোদ্দা কথা হলো, এই বদমাইশ গুলোকে মারবার জন্য যে ঠেকো ইঁদুর মারা বিষ লাগে তা আবার শুধু অফিসের বড়ো সাহেবের  পাতালপুরির চেম্বারেই লুকিয়ে রাখা থাকে, তাই নাগাল পাওয়া মুশকিল!  এরা সাধারণত বড়ো সাহেবদের পছন্দের লোক হয়, বড়ো সাহেবদের দাঁড়ে বসে ছোলা খায় আর সব রকমের ফাই ফরমাশ খেটে দেয় পোষ্য জন্তুর মতো! আর আছে একশ্রেণীর "খুব গম্ভীর আর ভয়ঙ্কর সাহেবের দল, না হাসার কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত সাহেবরা কিন্তু অসংখ্য গুপ্তচর আর দালাল পুষে রাখে তাদের পাতালপুরির চারদিকে!"....আমরা সবাই তো আর রূপকথার রাজপুত্র নয় যে রাক্ষস-রাক্ষসী বধ করে ইঁদুর মারা বিষ উদ্ধার করে আনতে পারবে, বাঁচাতে পারবে সত্যি ভালো মানুষ গুলোকে হিপোক্রাট শয়তানদের হাত থেকে!                                    ইতিহাস থেকে শিখেছি বেশি সংগ্রাম করতে গেলে কিন্তু ক্ষুদিরামের ফাঁসিতে লটকে যেতে হয়, তাই সাবধান, বেশি মুখ খোলার দরকার নেই, যেখান থেকে যেটুকু আসছে, জয় মা বলে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে হবে, ওই সাদাসিধে দাদাদের প্রাইমারি স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে, ওখানেই যে মুক্তি বিপ্লবী বাঙালীর!



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours