দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

 মিস্টার পারফেকশনিস্ট হিসেবে খ্যাত আমির খানও ভুল করে লগন সিনেমায় ছয় বলে ওভার দেখান। অথচ ১৮৯২ সালের পটভুমিকার ইংল্যান্ডে পাঁচ বলে ওভার ছিল। তবুও ভুল- ভুলই। সে ঐতিহাসিক ভুল বা রাজনৈতিক  ভুল হোক! ভুল বলার অধিকার সবার আছে! বিশেষকরে রাজনীতিবিদরা যখন একের পর এক বলেন। কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম স্থান বোলপুর বলতে পারেন! কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন মহাভুল বলেন, তখন সেটি শুধু মাথা ব্যাথার কারণ নয়, চিন্তার বিষয়, বলছেন অনেকেই!  

 সম্প্রতি নাট্যঘরে আয়োজিত এক বক্তৃতায় বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলে ফেললেন, বুধবার দিনটি পবিত্র নয় এবং কেশব চন্দ্র সেন অসামাজিক কাজে জড়িয়ে ছিলেন। অর্থাৎ তন্ত্র সাধনায় যুক্ত ছিলেন। শনিবারে ক্লাবে যেতেন। কেশব চন্দ্র সেন বললেন, শনিবারে আমার যাওয়া সম্ভব নয়, শনিবারে ক্লাবে যাওয়া আছে।  তাহলে বুধবারে ছুটি হোক।  অথচ, বিশ্বভারতীর সাথে কেশব চন্দ্র সেনের জীবনে কোন সম্পর্ক ছিল না। কেশব সেন মারা যান ১৮৮৪ সালে। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম চর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯০১ সালে। আর বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয়েছিল ১৯২১ সালে। আলোচনা প্রসঙ্গ ছিলঃ  পরিকল্পনা চলছে শনিবারকে ছুটির দিন হিসেবে নিয়ে আসা। কারণ ইউ জি সির অনেক জরুরি চিঠি আসে। সেটা বুধবারে আসলে কি হবে? ওই দিন তো ছুটি। এটার একটা যুক্তি আছে। আবার নিন্দুকদের কাছেও একটা যুক্তি আছে, উইকেণ্ডে বাড়ি যাওয়ার সুবিধা। যদিও, তাদের বিশ্বভারতীতে সপরিবারে থাকবেন, এটাই তো কথা।   

 উপাচার্যের এই মহাভুলে ভরা বক্তব্যের পর, নাট্যঘরে অনেকেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।  এক প্রবীন আশ্রমিক তো বলেই বসলেন, উপাচার্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশব চন্দ্র সেনের থেকে বেশি জানেন। এই ভুল বক্তব্যের ভিডিও ইউ টিউবের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র সমালোচনায় মুখর হন অনেকেই। এর আগেও চিন সফরের প্রাক্কালে তাঁর এক বক্তব্যকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হয়।

বিশ্বভারতী সূত্রে জানা গেছে, বুধবারের অনেক তাৎপর্য। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বুধবার সব থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ দিন। উনি যখন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে  গিয়েছিলেন, রাজপরিবারে গিয়ে দেখেছিলেন, বুধবার ছুটির দিন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বুধবার পছন্দ করতেন,  তার কারণ, খ্রিষ্টানদের উপাসনার দিন ছিল রবিবার, মুসলিমদের শুক্রবার,  ইহুদিদের শনিবার। উনি  ব্রাহ্মদের জন্য স্বতন্ত্র দিন চেয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের সময় ব্রহ্ম উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মদের যে বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল সেই দিনটি ছিল বুধবার। তারপর থেকে বুধবার শুরু হয়ে যায়। যখন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৯১ সালে তখন থেকেই বুধবারে উপাসনা চলে। অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে বুধবার দিনই উপাসনার দিন। রামমোহন রায়, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজের তিনি ধারা। রামমোহন রায় বিদেশ চলে গেলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের ভার নিলেন।  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যুবক। তখন কেশব চন্দ্র সেনের জন্ম হয়েছিল কী? কেশব চন্দ্র সেন সত্যেন্দ্র নাথ ঠাকুর সমবয়সী। কেশব চন্দ্র সেন যখন ব্রাহ্ম হলেন, তখন পিতার ত্যাজ্য পুত্র হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। কাজেই তরুণ কেশব চন্দ্র ছিলেন একান্তভাবে মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের অনুগত ভক্ত। উপাচার্য বলেন, কেশব চন্দ্র সেন তন্ত্র সাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি তন্ত্র সাধনার ধারে কাছে যান নি। কেশব চন্দ্র সেন শনিবারে ক্লাবে গিয়ে পার্টি করবেন, তার প্রমাণ কোথাও নেই। ব্রাহ্ম নৈতিকতায় এটা যায় না। শনিবার ও রবিবার বক্তৃতায় ব্যস্ত থাকতেন। জীবনের শেষ দিকে তাঁকে কখনও দেখা গেছে দক্ষিণেশ্বরে আবার কখনও পরমহংস রামকৃষ্ণ তাঁর সমাজের কাছে গেছেন। মনে রাখতে হবে, শ্রী রামকৃষ্ণ তন্ত্র সাধনার বিরোধী ছিলেন। তিনি যেটা করেছেন, সেটা হল, অদ্বৈত বেদান্ত সাধনা।  রামমোহন রায় মারা যান ১৮৩৩ সালে। পরে দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ও কেশব চন্দ্র সেনের দুই ধারায় ব্রাহ্ম সমাজ বিভক্ত হয়। যা হল দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও কেশব চন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ। পরে কোচবিহারের রাজ পরিবারে কেশব চন্দ্র সেনের মেয়ের বিবাহকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষীয় সমাজে আবার বিভাজন হয়।  সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ ও কেশব চন্দ্র সেনের নব বিধান ব্রাহ্ম সমাজ।  

দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’-য় অমিত-এর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ‘ফজলি আম ফুরোলে বলব না, আনো ফজলিতর আম”। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এ কোন দূরদর্শিতা চলছে, প্রশ্ন তো উঠবেই!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours