স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:
 
অনেকে প্রশ্ন করে এই বাংলায় এত কালীপূজো কেন হয় ? আবার অনেকে প্রশ্ন করেন গ্রামে গঞ্জে নানা সময়ে কালী পুজোর চল কেন ? এর উত্তর অবশ্য অনেক গবেষক খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে , স্থানীয় ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রামে গ্রামে কালী পুজোর চল শুরু হয়েছিল। আবার অনেকে বলেন শোষকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য, একদল দেশ প্রেমী কালীকেই শক্তির আধার হিসাবে ভেবে পুজো  শুরু করেন। তাঁদের যাবতীয় কার্যাবলীও পরিচালনা করতে শুরু করে কোন না না কোন কালী মন্দিরকে ঘিরে। সেকালে জমিদার আর ডাকাতরা বেশি করে কালীপুজো করতেন। আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবীরাও কালীর উপাসনা করতেন। ইংরেজপন্থী জমিদার বা ভূস্বামীদের তহবিল লুঠ করার আগে ওই বিপ্লবীরা কালীপুজো করতেন। আবার কার্যসিদ্ধি হলে ফিরে এসে  সাড়ম্বরে কালীপুজো করতেন তারা। সব মিলিয়ে প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে কালীপুজো এবং ডাকাত, দুই সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। এমনটাই মত গবেষকদের। 
স্বাধীনতা পুর্ব সময়ে ভবানিপাঠক বা পরবর্তী সময়ে বিশে ডাকাত বা রঘু ডাকাতদের ,গগন ডাকাতদের দেশের মানুষ রবিন হুডের ভুমিকায় দেখত। এই সব ডাকাতরা ধনী মানুষদের , বা অত্যাচারি জমিদারদের অত্যাচার থেকে গ্রাম বাসীদের মুক্ত যেমন করত ,তেমনি তাঁদের আপদে বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করত। ফলে তথা কথিত ডাকাতরা গরিব গ্রামবাসীদের কাছে দেবতাতুল্য ছিল। পরবর্তী কালে সেই সব ডাকাতদের মন্দির গ্রামবাসীদের কাছে আরাধ্যা দেবীর স্থান হয়ে উঠেছে। 
এবার আসা যাক রঘু ডাকাতের কথায়।
বিভিন্ন গবেষকদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে , রঘু ডাকাত মা কালীকে পুজো করত আদ্যাশক্তির রূপ হিসাবে।তাঁর পুজোর বিশেষত্ব ছিল ,মায়ের কাছে দেওয়া ল্যাটা মাছের পোড়া দিয়ে পুজো দেওয়ার পর সেই প্রসাদ খেয়ে বেরোলে যে কাজে তাঁরা বেরতেন ,সেই কাজে সাফল্য আসত।তাই ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে রঘু ডাকাত ও তার দলবল বাগহাটির জঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত মায়ের কাছে নরবলি ও ল্যাটা মাছের পোড়া দিয়ে পুজো দিতেন । বহু বছর আগেই নরবলির প্রথা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রথা মেনে আজও প্রতিদিন ল্যাটা মাছের পোড়া দিয়ে মায়ের পুজো হয় রঘু ডাকাতের কালী বাড়িতে। শুধু তাই নয় ৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বাঁশবেড়িয়া পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসুদেবপুরে রঘু ডাকাতের কালী বাড়িতে পুজোর দিন ল্যাটা মাছের পোড়া মহাভোগ হিসাবে দেওয়া হয়।   মায়ের এই মহাপ্রসাদ পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই দুর দুরান্ত থেকে ছুটে আসেন বহু ভক্ত। প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার ও অমাবশ্যায়, মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবস ও কালী পুজোর দিনে জাগ্রত এই মায়ের প্রসাদ পাওয়ার জন্য ভক্তদের লম্বা লাইন পড়ে।মন্দিরের পুরোহিত সুমন চক্রবর্তী বলেন, কথিত আছে প্রায় ৫০০ বছর আগে বাগহাটির জয়পুরের বাসিন্দা বিদূভূষণ ঘোষ ও তাঁর ভাই রঘু ঘোষ ঘন জঙ্গলের মধ্যে মায়ের মূর্তি স্থাপন করেন।ডাকাত দলের ভয়ে দুপুরের পর থেকে এই রাস্তা দিয়ে ভয়ে মানুষ চলাচল করত না। সুমনবাবু বলেন, পুর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ কোনও এক সময়ে এই রাস্তা ধরে ত্রিবেনী ফেরিঘাটে ফিরছিলেন। ওই সময়ে রঘু ডাকাতের লোকজন তাঁকে নরবলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে এসে বেঁধে রাখে। রাতে রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সেরে ফেলার পর বলি দেওয়ার আগের মুহুর্তে তিনি রঘু ডাকাতকে বলেন, তোরাতো আমাকে মেরেই ফেলবি তাই বলি দেওয়ার আগে মাকে একটি গান শোনানোর আর্জি করেন। সেই আর্জি মেনে রঘু ডাকাত গান শোনানোর অনুমতি দিলে রামপ্রসাদবলে একটি গান ধরেন। তারপরেই রঘু ডাকাত বলির হাঁড়িকাঠে রামপ্রসাদের পরিবর্তে মাকে দেখতে পান। তারপরেই রঘু ডাকাত বলি বন্ধ করে রামপ্রসাদের সেবার ব্যাবস্থা করেন। শুধু তাই নয় পরের দিন রামপ্রসাদকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে। এরপর থেকে মন্দিরে নরবলির প্রথা বন্ধ হয়েছে। তবে এখনও মানত করে পাঁঠাবলি হয়।
সিঙ্গুরে ডাকাতকালীর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সম্বন্ধে জানা যায় না। এই মন্দির ডাকাত সনাতন বাগদী না গগন সর্দার না রঘু ডাকাত নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আটচালা মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, বিষ্ণুর দশাবতারের মূর্তি ও পোড়ামাটির লতাপাতা খোদিত করা রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রায় নয় ফুট উচ্চ বিগ্রহ অবস্থিত। এই মন্দিরের মা কালী , মা  সিদ্ধেশ্বরী নামে পরিচিত।
এবার আসা যাক বিশে ডাকাতের কথায়।বিশে ডাকাত বা বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা। তিনিও কালী সাধক ছিলেন। এমনটাই বলেন গবেষকরা। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাকে 'বিশে ডাকাত' নামে আখ্যায়িত করেছেন।তিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাকে মানবদরদী ও কৃষকবীর বলেছেন। তার দানশীলতা ও বীরোচিত চরিত্রের জন্যে 'বাবু' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দরিদ্র ও নীলকর দ্বারা শোষিত জনসাধারণের জন্যে রাজনৈতিক ডাকাতির পথ অবলম্বন করেছিলেন। অনেকের কাছে তিনি নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবে গণ্য হন।
১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহের সাংগঠনিক রূপ দেন বিশ্বনাথ সর্দার। স্যামুয়েল ফেডি নামক অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামীন হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের একত্র করে বৃহৎ আন্দোলনের আকার দেন।শান্তিপুর এলাকার তাঁত শ্রমিক ও নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারে প্রতিশোধ নিতে বিশ্বনাথ শান্তিপুর কুঠি আক্রমন করে লুঠ করেন, ক্রমান্বয়ে চিত্রশালী নীলকুঠি ও নদীয়া ইন্ডিগো কনসার্নের নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি ধ্বংস করার পর নীলকর গোষ্ঠী আতংকিত হয়ে ওঠে। তার একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমনে ধুলিস্বাৎ হয়ে যায় খালিবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্তপুর, বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠি।
নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি তিনি আক্রমন করেন ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাত্রে। গ্রামবাসীরা ফেডিকে বন্দী করে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলেও বিশ্বনাথের দয়ায় সে রক্ষা পায় এবং প্রতিজ্ঞা করে নীলচাষ বন্ধ করে দেবে। যদিও মুক্তি পেয়ে জেলাশাসক ইলিয়টকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয় ফেডি। এর কয়েকদিন পরে ইংরেজ সেনাপতি ব্ল্যাক ওয়ার ও ইলিয়টের পুলিশ বিশ্বনাথকে ঘেরাও করলে সাথীদের প্রান রক্ষার্থে মহানুভব বিশ্বনাথ সংঘর্ষ এড়িয়ে যান ও আত্মসমর্পণ করেন।বিশ্বনাথ ধরা পড়ার পর বিচারের প্রহসন শেষ করতে ব্রিটিশ সরকার খুব দেরি করেনি। তার হত্যা ও হত্যা পরবর্তী কর্মকান্ড ছিল ব্রিটিশ সরকারের বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন। তাকে ফাঁসি দেওয়ার পর মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় পুরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় ও চিল শকুন দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পুলিশের খাতায় ডাকাত হিসাবে লেখা হত । এভাবেই অনেকে আজো ডাকাতের নামে ইতিহাসে চিহ্নিত।
যাইহোক আসি বিশে ডাকাতের কালীবাড়ির কথায়। নদিয়ার শান্তিপুর হল অদ্বৈতাচার্যের শ্রীপাঠ। সেখানে কালীপুজোর ইতিহাস কয়েক শতাব্দীর। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র রত্নগর্ভ সার্বভৌমের প্রচলিত পুজো এখানে সবচেয়ে প্রাচীন। শুধু তাই নয়, ‘ডাকাতে কালী’র সংখ্যা এখানে হাতে গুনে শেষ করা যায় না।ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে শক্তি, সাহস এবং সাফল্য প্রার্থনা করে বিশে ডাকাত সহ সব ডাকাতেরাই কালীপুজো করত। এমনটাই মত স্থানীয় মানুষের। গোটা নদিয়া জুড়ে ছিল বিশে ডাকাতের প্রভাব। ফলে স্থানীয় মানুষ আজো চিহ্নিত করতে পারেন নি কোন কালী মন্দিরটিতে বিশে ডাকাত মাতৃ আরাধনা করতেন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours