সুমিত তালুকদার, ফিচার রাইটার, উত্তর ২৪ পরগনা:

মহিষাসুর জন্মের এক অদ্ভুত কাহিনী আছে, বিশেষত কেন মহিষরূপী অসুরকেই বধ করবেন মা দুর্গা। অন্য কোনো প্রাণীকে অসুররূপে কল্পনা ও প্রাধান্য দেওয়া হয়নি কেন পৌরাণিক আখ্যানে। দুই অসুর ভাই রম্ভ আর করম্ভ। করম্ভের অকালমৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত রম্ভ হঠাৎ বসে গেলেন ঘোরতর তপস্যায়। দেবাদিদেব শিব তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন যে রম্ভের ইচ্ছানুসারে আগামী তিন প্রজন্ম ধরে তিনি তাঁর পুত্র হিসাবে জন্ম নেবেন। তবে সুকৌশলে মহাদেব আরও যোগ করে বললেন – “যার প্রতি চিত্ত সমর্পণপূর্বক তুমি তোমার এই নশ্বর দেহটি অর্পণ করবে তাঁর গর্ভেই জন্ম নেবে সেই পরাক্রমশালী কাঙ্ক্ষিত পুত্র”।  এভাবে বরলাভে মহানন্দে রম্ভ একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছান যক্ষ পদ্মনিধির কাছে। সেখানে বিহাররত নানাবিধ পশু যেমন, গজ, অশ্ব, অজ প্রভৃতির পাশাপাশি বছর তিনেকের ফুটফুটে ঋতুমতী নাবালিকা মহিষও ছিল। কামাতুর রম্ভ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেই মহিষীনীর সাথে তৎক্ষণাৎ রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হন। জন্ম হয় এক বিচিত্র বর্ণশঙ্কর ভয়ংকর মহাবলী পুত্রের – মহিষাসুরের।
এরপর শুরু হোলো মহিষাসুরের অমিতবিক্রম প্রদর্শন এবং দেবতাদের স্বর্গরাজ্য দখলের দুরভিসন্ধি। মদমত্ত অহংকারী মহিষাসুর ক্ষমতালিপ্সায় অন্ধ হয়ে হঠাৎ একদিন মারাত্মক ভুল করে বসলেন। ঋষি কাত্যায়নের এক তেজস্বী শিষ্য ছিলেন, নাম রৌদ্রাশ্ব। তিনি যখন গভীর বনে একাগ্র চিত্তে তপস্যায় মগ্ন তখন মায়াবলে মহিষাসুর ছলনাময়ী নারীরূপে তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে উদ্যত হন। ঋষি তাঁর ছলনা জানতে পেরে মহিষাসুরকে অভিশাপ দেন – যে স্ত্রী- রূপ ধারন করে তুমি আমায় বিভ্রান্ত করলে সেই স্ত্রী – জাতির হাতেই তোমার মর্দন বা হনন হতে হবে। তিন মন্বন্তর নিষ্কণ্টক অসুর রাজ্যের ভোগী রাজাধিরাজ মহিষাসুরও এমন আশ্চর্য ভবিষ্যতবাণী শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু নিয়তি অলঙ্ঘনীয়। সৃষ্টি হোলো মহিষাসুর বধের জন্য বিশেষভাবে দৈবপ্রভাবদ্বারা প্রস্তুত এক অবধ্যা চন্ডীরূপিণী ভয়ংকরী দশভুজা নারী মূর্তির – মহিষাসুরমর্দিনীর। মহিষাসুর অবশেষে বধ্য হলেন। কিন্তু ষোড়শভূজা ভদ্রকালীর আশীর্বাদে তাঁর স্থান হোলো মহামায়ার পদতলে, পুজোও পেলেন তাঁর সাথে একাসনে। কেননা পূর্বে দেবাদিদেব শিবের দেওয়া বরের তিনজন্মের প্রথম সৃষ্টিতে উগ্রচণ্ডা মূর্তিতে মহিষাসুর তাঁর হাতে নিহত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় সৃষ্টিতে ভদ্রকালী মূর্তিতে আর এখন শেষ জন্মে নিহত হলেন অসুর মূর্তিতে। প্রথম দুটিতে পদতলে গ্রহণ করেননি, কিন্তু এই শেষবারে মহিষাসুরের সব পাপ আসুরিক শক্তিকে পরাভূত করে তাঁকে ক্ষমা করে পদতলে স্থান দিয়ে গ্রহণ করলেন মহামায়া।
আসলে ঘটনার ক্রমগুলি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় শিবই মহিষাসুর, মহিষাসুরই শিব। তন্ত্রযোগিনী শাস্ত্রে, কালিকাপুরাণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই বলা হয় – “মহিষ ত্বং মহাবীর শিবরূপঃ সদাশিব”। এ তো গেল পৌরাণিক আখ্যান এবং মাতৃতান্ত্রিক যুগের কথা। মহিষ-রাজার সম্পর্কে আবার অন্য তথ্যও মেলে। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা, মালবাজার, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ডের আদিম জনজাতির মধ্যে অসুর সম্প্রদায়ের খোঁজ মেলে। বাস্তবের এসব রক্তমাংসের অসুরেরা মহিষাসুরমর্দিনীর মহিষাসুর নিধনের ব্যাপারকে অনৈতিক ও নারীজাতির ছলনা বলে মনে করে। তাঁরা ‘মহিষাসুর দিবস’ পালন করে এবং দুর্গাপুজো বা নবরাত্রির দিন অশৌচও পালন করে। এই ‘হুদুর দুর্গা’-তে আজও মহিষ রাজার স্মৃতি অম্লান। সাঁওতাল, মুন্ডা, অসুর – প্রায় প্রত্যেক জনজাতিতেই রয়েছে জনপ্রিয় মহিষ- রাজা ও ছলনাময়ী এক নারীর উপাখ্যান। এতে আছে মহিষ – রাজার মাথায় আদৌ শিং ছিল না, তিনি লোহা গলাতেন, প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। কালক্রমে এসবই বিস্মৃতপ্রায় আজ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours