দেবলীনা চৌধুরী, সাংবাদিক, জিরাট, হুগলি:

"পৃথিবীটা নাকি  ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রইংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী"- বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির এই গানের সাথে সকলেই পরিচিত। বর্তমানে পৃথিবীতে আরও সংকুচিত হতে হতে হাতের মুঠোয় এসে গেছে আর যেটার রূপ হচ্ছে মুঠোফোন। যোগাযোগ, যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজের সাথে সাথে বিনোদনও সবসময় আমাদের হাতের মুঠোয়। একাকীত্ব দূরীকরণেরও এক বিশেষ সঙ্গে হয়ে উঠেছে এই মুঠোফোন।

একাকীত্ব এমন একটি অনুভূতি যা কাউকে সমৃদ্ধ করতে পারে, আবার কাউকে ভেতর থেকে সম্পূর্ণ ধ্বংসও করতে পারে।  যে একাকীত্ব মানুষ ভেতর থেকে উপভোগ করে অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি 'Solitude' তাতে মানুষের প্রবল উপকারই হয়ে থাকে, বিশেষত কোন সৃষ্টিশীল কাজের পক্ষে তা খুবই ফলদায়ী। কিন্তু যে একাকীত্বকে আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি তা হলো যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ’Loneliness' যা মানুষের সৃষ্টিশীল সত্তাকে ধ্বংস করে, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ করে তোলে।
মন ফুরফুরে মেজাজে থাকুক  কিংবা  মনের মধ্যে মন খারাপের মেঘ জমে থাকলে, তার খবর স্ট্যাটাস আপডেট এই জানান দেয়। 
তাই এখন পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে নির্ভেজাল আড্ডাও খুব কম চোখে পড়ে।  রাজনীতি, খেলাধুলা প্রভৃতি বিষয়ে এখন আলোচনার অতীত। সেখানেও কেবল দৃষ্টি আবদ্ধ থাকে মুঠোফোনে। ট্রেনে পাশের সিটে বসা বয়স্ক ভদ্রমহিলা চোখের জলের দিকে তাই আর আমাদের দৃষ্টিপাত হয় না। মুঠোফোন থেকে একবারও আমরা চোখ সরিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করি না তার কষ্ট ও দুঃখের কারণ অথচ এটাই আমরা বাস্তবজীবনের আখ্যা দিয়ে থাকি।
কিছু সময় আগে  প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী আশা ভোঁসলে জি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন যে ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তার সঙ্গীদের সাথে এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত, কিন্তু তিনি বাদে সকলেরই নজর মুঠোফোনের দিকে। তাতে তিনি যথেষ্ট নিরাশ ই হয়েছিলেন। নিজেদের একাকীত্ব দূরীকরণের নেশাতে কিভাবে আমরা আমাদের কাছের মানুষগুলোকে প্রবল মাত্রায় পর করে দিই আমরা নিজেরাই অনেক সময় বুঝতে পারিনা আর দুর্ভাগ্যবশত 'খলনায়কের ভূমিকায় মুঠোফোন'। এখন ছোট শিশুদের হাতেও মুঠোফোন, বাস্তব জগতের সাথে তাদের নিজের অজান্তেই এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি করে ফেলছে তারা। আর তাই খালি থেকে যাচ্ছে অপেক্ষারত দাদু-ঠাকুমার  কোল, যারা চিরকাল থাকবেন না। আর তাই "ঠাকুরমার ঝুলি" ও যেন তার সকল রূপকথাকে আজীবনের জন্য অপ্রকাশিত মোড়কে লিপ্ত করে নিচ্ছে।
এই মুঠোফোন সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। বেশ কিছু মানুষ যাদের ছেলে-মেয়ে প্রবাসী, তাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতে সাহায্য করে এই মুঠোফোন।  ভিডিও কলিং এর মাধ্যমে যখন নাতি-নাতনির  মুখ স্ক্রিনে ভেসে ওঠে তখন এক আলাদা তৃপ্তি পায় বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত চোখগুলো। কিন্তু কিছু সময় এই মুঠোফোন যাকে আমরা আপাতদৃষ্টিতে বহন করে ভাবছি, সমগ্র পৃথিবীটাকে সঙ্গে বহন  করছি,  তাকেই অনেক সময় আমরা যন্ত্রের থেকে বেশি মর্যাদা দিয়ে ফেলি। সে যেন যন্ত্র হিসেবে আমাদের জীবনে যতটা মর্যাদা পাওয়া উচিত ততটাই পায় তা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। নইলে এই মুঠোফোন নামক যন্ত্র যে কখন আমাদেরকে তার মুঠোর কবলে নিয়ে 'একাকীত্ব' দূরীকরণের নামে বাস্তবিক সম্পর্কগুলোকে শেষ করে দেবে আমরা বোধহয় সেটা সময় থাকতে উপলব্ধি করতে পারব না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours