দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
যেখানে সামাজিক বার্তা লক্ষ্য, সেখানে “নো চার্জ ফর ডেলিভারি ” হবে স্বাভাবিক। তাই যোগাযোগ করলে পাবেন – “নো চার্জ ফর ডেলিভারি”। এটা কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পুজো অফার নয়। তবে সেটা তাদের জন্য, যাঁরা কোন কারণে বাজারে গিয়ে কিনতে পারেন না। জানা গেছে, জেলার কুমোরদের কাছে সর্ব্বমোট হাজার খানেক প্রদীপ কিনে ৫১টি করে মাটির প্রদীপ উদ্যোক্তাদের উপহার দেবেন তাঁরা। একই সঙ্গে সলতে এবং তেল দেওয়া হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও ফুটেজে ফুটে উঠেছে প্রদীপ কিনে বাড়ি সাজানো, উপহার দেওয়ার বার্তা! এই প্রশংসনীয় উদ্যোগে “দেবার্ঘ্য”। দেবার্ঘ্য এমন একটি নাম! বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের এরকম সংগঠন দেখা যায়। যারা সমাজের জন্য কিছু করতে চায়! “দেবার্ঘ্য” তাদের মধ্যে অনন্য। এঁদের কেউ পড়ুয়া, কেউ চাকরিপ্রার্থী। কালীপুজোয় মাটির প্রদীপ বিক্রেতাদের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁরা একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন। যার নাম "দেবার্ঘ্য -- দীপশিখা জ্বালিয়ে"।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা
নয়ন ছলো ছলো,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ
বাইরে নিয়ে চলো।
যদিও আকাশ প্রদীপ নিয়ে গুরুদেবের এই লেখা । তবে মনে করিয়ে দেয় তাদের কথা যাঁরা ব্রাত্য থেকে যান আলোর উৎসবে! হ্যাঁ, কুমোরদের কথায় হচ্ছে! বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, কালীপুজোয় ইলেকট্রিক আলোর রোশনাইয়ের আধিপত্য! কিছু করার নেই, একবার এই বাতি কিনলে, নিশ্চিন্তে বেশ কয়েকবছর কেটে যায়। তবে এখনও আভিজাত্যে মাটির প্রদীপ সেরা! সেটা বোঝার থাকলেও, মধ্যবিত্ত বাঙালি হৃদয়ের থেকে পকেটের কথায় বেশি শোনে বোধ হয়! তাই উচ্চবিত্ত বাহারি বিদ্যুৎ আলোর রোশনাই বাতি নিম্ন বিত্ত মাটির প্রদীপকে বলে- “ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে”। সেটা থেকে বেরিয়ে আলোয় বাড়ি সাজানোর পরিবর্তে মাটির দীপে সাজানোর বার্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে দেবার্ঘ্য।
বিষয়টি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত বিশ্বভারতী বিনয়ভবনের ছাত্রী দেবস্মিতা চ্যাটার্জী জানালেন, তাঁরা ঠিক করেছেন কালীপুজোর দুদিন আগে পর্যন্ত হাজারখানেক মাটির প্রদীপ কিনবেন। বোলপুরে যাঁরা প্রদীপ তৈরি করেন তাঁদের পাশাপাশি শহরের রাস্তার পাশে বসে যাঁরা প্রদীপ বিক্রি করেন তাঁদের থেকেও কিছু করে প্রদীপ কিনে নেবেন। প্রত্যেকের কাছেই যাতে কিছুটা করে প্রদীপ কেনা যায় সেই চেষ্টাই করছেন। এর পর সেই প্রদীপগুলি স্থানীয় কালীপুজো উদ্যোক্তাদের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেওয়া হবে। ঠিক হয়েছে, ৫১টি করে মাটির প্রদীপ উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সলতে এবং তেল দেওয়া হবে। কালীপুজোর রাতে সেই প্রদীপগুলি জ্বলে উঠবে। এ ভাবে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দেওয়ার মাধ্যমেই নয় মাটির প্রদীপ কিনে কী ভাবে সেটি কাজে লাগানো যেতে পারে তার পথ দেখানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। এ বছর বোলপুর, রামপুরহাট, দুর্গাপুর, ভেদিয়ার শহর এবং গ্রামের পুজো কমিটি, বাড়ির পুজোকে উপহার দেওয়া হবে বিক্রেতাদের থেকে কিনে নেওয়া মাটির দীপগুলি। সবাই যখন মুখে সাহায্যের কথা বলছেন, তখন ওরা শুধু সোশ্যাল সাইটে স্ট্যাটাসের মধ্যে সীমিত না থেকে নেমে পড়েছেন মাঠে।
মুকুল মাহাতো, সৌরভ সাহা, শুভজিৎ পাঁজাদের কথায়, "দুর্গাপুজোতে আমরা শিশুদের নতুন জামা উপহার দিই। কালীপুজোয় নতুন কিছু করার ভাবনা ছিল। নিজেদের হাত খরচ কিংবা সামান্য উপার্জনের টাকা জমিয়ে এই কাজ। তাই কিছু দিনের ফারাকে বড় বাজেটের কোনও কাজ করা সম্ভব ছিল না।" শিবম রায়, কালীপ্রসন্ন মণ্ডলরা জানালেন, এই ভাবনা যাতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে সেই কথা মাথায় রেখে তাঁরাও একটি ভিডিও বানিয়েছেন। যেখানে মাটির প্রদীপ তৈরির বিভিন্ন ধাপ তুলে ধরা হয়েছে এবং প্রদীপ কিনে বাড়ি সাজানো, উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ভিডিও দেখে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাঁরা হয়তো বিভিন্ন কারণে বাজারে গিয়ে প্রদীপ কিনতে পারেন না। এ রকম কিছু বাড়িতে কোনও ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই প্রদীপ পৌঁছে দেওয়া হবে। সৌজন্যে দেবার্ঘ্য! তাই ‘দেবার্ঘ্য’র জন্য বলা যেতেই পারে, এতদিন – দ্বীপ ছিল শিখা ছিল/ শুধু তুমি ছিলে না/ বলে আলো জ্বললো না …
Post A Comment:
0 comments so far,add yours