গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

‘মাই নেম ইজ গহরজান' তিনি মিস গহরজান, জীবদ্দশাতেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা ‘মিথ’, তাঁর গ্রামোফোন রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। মৃত্যুর এতো বছর পর আজও তিনি এক কিংবদন্তী।                            জন্মসূত্রে এই গহরজান কিন্তু মুসলিম ছিলেন না, উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্ম হয় যে অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োয়ার্ডের পরবর্তী কালে তিনিই হয়ে ওঠেন বিখ্যাত সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী গহরজান। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইহুদি, তার মায়ের নাম ছিল ভিক্টোরিয়া হেমিংস আর বাবা ছিলেন রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড। অ্যাঞ্জেলিনা অর্থাৎ গহরজানের বাবা মা, ভিক্টোরিয়া ও রবার্টের দাম্পত্য জীবন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, এক মুসলিম যুবক খুরশিদের সাথে ভিক্টোরিয়া ও অ্যাঞ্জেলিনা চলে আসেন আজকের বারাণসী শহরে। আর এই বারাণসীতে এসে  মা ও মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তারপর মা ভিক্টোরিয়ার নাম হয় মালকাজান এবং ছোট্ট মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা নাম হল গহরজান।
গহরজানের মা  মালকাজানও ভাল গান গাইতে পারতেন এবং উর্দু কবিতা লিখতে পারতেন। ছোট্ট বেলা থেকেই শুরু হয়  গহরজানের সঙ্গীতের তালিম,আর তার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঈজিদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চার বছর বারাণসীতে থাকার পরে খুরশিদ, মালকাজান ও গহরজান চলে আসেন কলকাতায়।
শুরু হয় তাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কলকাতায় তাঁদের প্রথম ঠিকানা হয়েছিল এই শহরেরই কলুটোলা অঞ্চলে। দেশের নামকরা রাজা-মহারাজাদের দরবারে মালকাজানের ডাক পড়ত সে সময়ে, এমনই এক সময়ে মালকাজান আমন্ত্রণ পেলেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের দরবার থেকে, আর সেখানেই কত্থকের প্রবাদপ্রতিম গুরু বিন্দাদিন মহারাজ প্রথম গহরকে দেখেন, আর প্রথম দেখেতেই বুঝতে পেরেছিলেন গহরজানের প্রতিভা। এরপর শুরু হয় গহরের নাচের তালিম, এবং পাশাপাশি চলতে থাকে গানের তালিমও। গহরজান বাংলা গান শিখেছিলেন বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে, কীর্তন শিখেছিলেন রমেশচন্দ্র দাস বাবাজির কাছে, ধ্রুপদী সঙ্গীত শিখেছিলেন শ্রীজান বাঈয়ের কাছে এছাড়া তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতেরও শিক্ষা নিয়েছিলেন।                         
প্রতিভাময়ী গহরজান অসংখ্য ভাসায় গান গাইতে পারতেন যেমন হিন্দি, বাংলা, উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, সংস্কৃত ইত্যাদি। তাঁর প্রথম একক মেহেফিল দ্বারভাঙার মহারাজা লক্ষ্মেশ্বর সিংহের দরবারে, আর তারপর থেকেই গহরজানের নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
1901 এ কলকাতায় আসে গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেড, সেই থেকে যাত্রা শুরু এ দেশে গ্রামোফোন রেকর্ডের আর প্রথম যুগের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম এই গহরজান। সে সময় কোম্পানির রেকর্ডিস্ট হিসেবে ছিলেন গেইসবার্গ সাহেব, রেকর্ডিং-এর প্রথম দিনেই গেইসবার্গ বুঝে গেছিলেন এই গহরজানই একদিন হয়ে উঠবেন এ দেশের ‘গ্রামোফোন কোম্পানির টপ সেলিব্রিটি’। প্রথম থেকেই গহরজানের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস আর স্বতঃস্ফূর্ততা। চল্লিশের দশক পর্যন্ত তিনি থেকে গেছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। সেই যুগেই এক-একটি রেকর্ডিং সেশনের জন্য তিনি নিতেন প্রায় তিন হাজার টাকা!
নাখোদা মসজিদের পাশেই এক প্রাসাদসম বাড়িতে থাকতেন গহরজান, বাড়ীর নাম রেখেছিলেন সাধ করে ‘গহর বিল্ডিং’। তাঁর বিলাসী জীবনযাপনের কথা মানুষের মুখে মুখে তখন ঘোরা ফেরা করত, শোনা যায় তার পোষা বেড়ালের বিয়েতে তিনি কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে ছিলেন। গহরজানের আরও একটা অসাধারণ গল্প, একবার জোড়াসাঁকোর মল্লিকবাড়ির অনুষ্ঠানে ডাক পেলেন গহরজান, সেই আসরে ছিল গণ্যমান্য বাঙালি, পঞ্জাবি, মাড়োয়াড়ি আর নামকরা সাহেব অতিথিরা। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মল্লিকবাড়ির কর্তাকে গহরজান অনুরোধ করলেন, অতিথিদের বসার ব্যবস্থা যেন ভাষা অনুযায়ী আলাদা আলাদা হয়, এইরকম অনুরোধ শুনে গৃহকর্তা তো এক্কেবারে  হতবাক! কিন্তু গহরজানের মতো শিল্পীর অনুরোধ ফেলা সোজা কথা নয়, তাই তিনি অতিথিদের আলাদা আলাদা বসার ব্যবস্থাই করলেন। এরপরে বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিত হয়ে আসর প্রবেশ করলেন সুন্দরী গহরজান, প্রথমে যে দিকে সাহেবরা বসেছিলেন সেখানে গিয়ে একটা কুর্নিশ করে একটা ইংরেজি গান দিয়ে শুরু করে একে একে পঞ্জাবি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে ধরলেন একটি পঞ্জাবি গান, মাড়োয়াড়ি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে ধরলেন একটি হিন্দি দাদরা ও ঠুমরি এবং সর্বশেষে বাঙালি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে শুনিয়েছিলেন একাধিক বাংলা গান, সেদিনের উপস্থিত শ্রোতারা মুগ্ধ এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন গহরের এই অভিনব পরিবেশনায়। এমনটাই ছিলেন গহরজান।                                                        সে যুগে দেশলাইয়ের বাক্সে থাকত গহরজানের ছবি, পাওয়া যেত গহরজানের ছবিওয়ালা রঙিন পোস্টকার্ড।
কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেটেছিল নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে, বার বার ভালোবাসার বিনিময়ে পেয়েছিলেন শুধু আঘাত। তিনি যদিও বিয়ে করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে সুখ তার কপালে জোটেনি, তার জীবনে যেমন একদিকে ছিল খ্যাতি, অর্থ, মান সম্মান অন্য দিকে তেমনই ছিল নিসঙ্গতা আর একাকীত্ব। তাঁর এক ম্যানেজার আব্বাস এক সময় তার খুব ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিলেন, শোনা যায়, পরে সেই আব্বাসই গহরজানের সঙ্গে সব থেকে বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আর সেই কারণেই গহর হারিয়ে ছিলেন প্রচুর ধন-সম্পত্তি। শেষপর্যন্ত 1928 সালে মাসিক মাত্র পাঁচশ টাকা বেতনের বিনিময়ে মহীশূর দরবারে সভা-গায়িকা নিযুক্ত হয়েছিলেন গহরজান এবং কলকাতা ছেড়ে চিরকালের মতো পাড়ি দিয়েছিলেন মহীশূরে।এর ঠিক দুবছর পরে, 1930 তে জানুয়ারি মাসে  মহীশূরেই গহরজানের মৃত্যু  হয়।                                                                  গহরজান শুধু মাত্র এক প্রতিভাবান সঙ্গীতসাধিকাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সে যুগের পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এক অসামান্য নারী চরিত্র। 'সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী গহরজান' এই পরিচয়ের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অপমান, লাঞ্ছনা ও বিকিয়ে যাওয়া নারীজীবনের অবমাননার করুন কাহিনী। বাবুদের লোভী নজর আর ছলনার গ্রাসে ঠকতে ঠকতে একসময় ঠগবাজ বাবুদের উপস্থিতি এই গহরজানের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তিনি বুঝতে শেখেন সঙ্গীতশিল্পী হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত পুরুষের অবদমিত কামনার বস্তু, লাঞ্ছিত উপেক্ষিত এক নারী, তাই গহরজানের পরিচয় শুধুমাত্র সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী হিসেবে নয়, তিনি ছিলেন সেকালের সুরাপায়ী লম্পট বিলাসী বাবুসমাজের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এক প্রতিবাদী নারী কণ্ঠস্বর। তাই মৃত্যুর এত বছর পরেও রঙ্গমঞ্চে তাঁর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়...‘মাই নেম ইস গহর জান’।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours