কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

চারদিকে তখন জোড়ায়-জোড়ায়।
পাহাড়চূড়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে যৌনতার। আঁশটানি গন্ধ বাতাসে। আর শীৎকার ধ্বনি।
সূর্য তখন পাটে বসেছে।
পাখিরা ফিরছে নিজের বাসায়। তাদের কিচির-মিচিরে আরও এক সুরেলা বেলাশেষ।
ঠান্ডা বাতাস পাহাড়চূড়ায়। বেশ একটা হিম-হিম ভাব। আলোছায়ার খেলা গোটা উপত্যকা জুড়ে। রহস্যে ঢাকা পাহাড়চূড়ায় ততক্ষণে জোড়া জোড়া নরনারী মেতে উঠেছে শরীরীখেলায়। একেবারেই মুক্তাঙ্গন। খোলা আকাশের তলায় গণযৌনতা। নিছক যৌনতা বলাটা একেবারেই ঠিক হবে না। বরং বলা ভালো যৌনতা, আধ্যাত্মিকতার এক ককটেল। কেমন যেন এক অপার্থিব সন্ধ্যা পাহাড়চূড়ায়। উত্তেজনার সঙ্গে মিশে যায় এক গা ছমছম ভাব।
মনে হচ্ছিল, খাজুরাহোর সব সুন্দর সুন্দরীরা নেমে এসেছিল আলো আঁধারীর পাহাড়চূড়ায়।
পাহাড়ের নাম মাউন্ট কেমুকাস। স্থানীয় মানুষরা বলেন সেক্স হিল। ইন্দোনেশিয়ায় স্রাগেন রিজেন্সি এলাকায়। সেখানেই জাভানিসদের এক ধর্মস্থান, গুরুং কেমুকাস। এই ধর্মস্থান অবশ্য বিশেষ এক সম্প্রদায়ের। যৌন উৎসবও তাঁদের। যৌনতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে একাকার। রতিক্রিয়ায় আরোপ করা হয়েছে দেবত্ব। তবে এই উৎসবের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়তেই, বাইরে থেকেও অনেক মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করেন সেই পাহাড়চূড়ায়।

উৎসবের দিন সকাল থেকেই ভিড় জমতে থাকে মাউন্ট কেমুকাসে। ওই পূণ্যতিথির নাম জুমাত পন। প্রথমেই সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি। তারপর রীতি রেওয়াজ মেনে প্রার্থনা, আরাধনা। সমাধির তলায় চিরনিদ্রিত রাজকুমার প্যাঙ্গেরান সোমোদ্রো আর তাঁর সৎমা নিয়েই আন্ত্রোউলান। সম্পর্ক যাই হোক না কেন, প্রেমে পড়েছিলেন দুজনা। রাজমহলে প্রেম চলবে আর রাজার কানে যাবে না, তাও কী হয়? মহারাজের আদেশে দুজনকেই তাড়িয়ে দেওয়া হলো প্রাসাদ থেকে। রাজকোষের হাত থেকে বাঁচতে তারা আশ্রয় নিলো মাউন্ট কেমুকাসে। ক্লান্ত, শ্রান্ত দুই প্রেমী তখন বিধ্বস্ত। তাঁরা একে অপরকে আশ্রয় করতে চাইলেন। ঘনিষ্ঠ হলেন একটু উষ্ণতার খোঁজে। ঝড় উঠলো ইন্দ্রিয়ে। নিভৃতে দুজনে দুজনকে পেয়ে মেতে উঠলেন রতিক্রিয়ায়।

ওদিকে ততক্ষণে প্যাঙ্গেরানের পিছু ধাওয়া করতে করতে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে গেছে রাজার সেনা। হাজির এলাকার উৎসাহী মানুষরাও। তর সাইলো না কারুর। ওই ঘনিষ্ঠ অবস্থাতেই খুন করা হলো প্যাঙ্গেরান আর তাঁর প্রেমিকা সৎমা নিয়েইকে। তারপরেই তাঁদের পুঁতে ফেলা হলো ওই পাহাড়চূড়াতেই। সেদিনটা ছিলো কোনও এক শুক্রবার। ষোড়শ শতাব্দীর সেই নারকীয় ঘটনাকে স্মরণ করেই,  মাউন্ট কেমুকাসের গণরতিক্রিয়া উৎসব।

অনেকের বিশ্বাস, দুই প্রেমিক প্রেমিকা রতিক্রিয়ায় চরম পরিতৃপ্তি পাওয়ার আগেই খুন হয়ে যায়। তাঁদের সেই অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করতেই বসে এই যৌন উৎসবের আসর। শর্ত একটাই, মাততে হবে বাঁধভাঙা যৌনতায়। তবেই মিলবে মৃত রাজকুমার আর তাঁর প্রেমিকার আশীর্বাদ। বেশ কয়েকবার উৎসবের এসেছেন এমন মানুষরা বলেন, "হাতেনাতে ফল মিলেছে। ঘুরে গেছে ভাগ্যের চাকা।"

এই উৎসবের আরেক মজার কথা, প্রথা মেনে পাহাড়চূড়ায় কেউ কোনও যৌনসঙ্গী নিয়ে আসে না। উৎসবস্হলের পবিত্র সরোবরে অবগাহনের সময় থেকেই খোঁজা শুরু হয় যৌনসঙ্গী। সারাদিন কেটে যায় সঙ্গসুখে। সূর্যাস্তের পরেই শরীরে প্রবেশ। ঢালাও যৌনতা। এরা কেউ কাউকে চিনতো না কয়েক মুহূর্ত আগেও। উৎসবপ্রাঙ্গনে এসেই আলাপ। কয়েক হাজার আগন্তুক সেক্স করে চলেছে খোলা আকাশের নীচে। কেউ গাছের তলায়। ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আবার অনেকে উন্মুক্ত প্রান্তরে। সাক্ষী, চন্দ্র গ্রহ তারা। আর সবার অলক্ষ্যে থাকে অতন্দ্র দুই বিদেহী অতৃপ্ত আত্মা নিয়েই আর প্যাঙ্গেরানের।

সকালে উৎসব শেষে ক্লান্ত যৌনসঙ্গীরা নিজেদের ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার একে অন্যকে দেয়। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলে। ফের তারা পাহাড়চূড়ায় ফিরে আসে পঁয়ত্রিশ দিনের মাথায়। আরাধনা করে গুরুং কেমুকাসে। ওই এক রাতের সেক্সেই উৎসব সমাধা হয় না। পঁয়ত্রিশ দিনের অন্তরে পরপর সাতবার সেক্স করতে হবে অতৃপ্ত আত্মার কৃপাদৃষ্টি পেতে।

সব জায়গাতেই মতলববাজ থাকে।
যৌন উৎসবে ভিড় উপচে পড়তে দেখে এলাকার কিছু মানুষ হোটেল বানিয়ে ফেলে পাহাড়চূড়ায়। বসে যায় দোকানপাট। মোটামুটি ভাবে এক পর্যটনকেন্দ্রের চেহারা নেয় ধর্মস্থল। উৎসব যৌনতার। তাতে আবার আছে সঙ্গী খোঁজার ঝক্কি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দু'পয়সা রোজগার করে নিতে হাজির দেহোপজীবিনীরাও। ২০১৪ নাগাদ তাদের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে এলাকার মানুষের অভিযোগ, উৎসবের সামিল মহিলাদের একশোজনের মধ্যে কমপক্ষে পঁচাত্তরজনই দেহব্যবসায়ী। অভাব হয় না খরিদ্দারেরও।
পরিবেশ এতটাই বদলে যেতে থাকে যে স্থানীয় কিছু মানুষ অন্যত্র চলে যায়। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এলাকার মানুষের। সমস্যার দিকে নজর ঘোরে সরকারেরও। ততদিনে আশপাশের বেশকিছু এলাকা থেকে খবর আসতে থাকে নানা যৌনরোগ সংক্রমণের। এলাকার মানুষ, সরকারের চাপে ঝাঁপ ফেলে হোটেল, দোকানপাট। পুরোপুরি বন্ধ না হলেও দাপট কমেছে দেহব্যবসার।

উৎসবে পসরা নিয়ে বসার জন্য কর বেঁধে দিয়েছে সরকার। ওদিকে শুরু হয়েছে মোটা টাকা প্রবেশকর আদায়ের কাজ। ওই টাকা মেটালেই পুণ্যার্থীরা উৎসব প্রাঙ্গণে ঢোকার অনুমতি পাবেন। সরকারি নিয়ন্ত্রণ চালু হওয়ায় সুফল মিলছে বলে মত এলাকাবাসীর। সবাই আশা করছেন, কিছুদিনের মধ্যেই মাউন্ট কেমুকাস ফিরে যাবে তার আদি অকৃত্রিম চেহারায়। কলঙ্ক মোচন হবে গুরুং কেমুকাসের। উৎসবের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকবে তার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours