ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ দুর্গাপুর মহকুমার বৃহত্তম ব্যবসা কেন্দ্র ভিরিঙ্গী বাজারের মধ্যস্হলে নাচন রোডের ধারে ভিরিঙ্গী শ্মশান কালী মন্দির!
আজ থেকে ১৬৬ বছর আগের কথা! ভিরিঙ্গী তখন প্রত্যন্ত গন্ড গ্রাম! কুমোর বাঁধের পাড়ে গ্রামের শ্মশানে ইং ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা ১২৫৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়নের অমাবশ্যার রাত্রে শ্মশান কালী মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামের নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মন দম্পতি ন'কড়ি রায় কৃতার্থময়ীর সন্তান অক্ষয় কুমার রায়!
এই মায়ের প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে আছে এক অলৌকিক কাহিনী! ১২৪১ বঙ্গাব্দ বৈশাখী পূর্নিমার শুভলগ্নে রাত্রি ১০ টায় নকড়ি রায়ের ঘর আলো করে রত্নগর্ভা কৃতার্থময়ীর গর্ভে জন্ম নিল এক শিশু! এতো শিশু নয় যেন দেব শিশু! সেই শুভ মূহূর্ত ঘোষিত হ'ল শঙ্খ ধ্বনিতে! কিন্তু সেই খুশী আশঙ্কায় পরিনত হতে দেরী হয়! শিশু শব্দের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেয় না! বাড়ীর সকলে প্রমাদ গনলেন! সকলেই বুঝতে পারলেন এই শিশু বধির এবং এর পরিনতি বোবা হয়ে থাকতে হবে সারা জীবন!
পুত্রের আগমনের খুশী নকড়ি ও কৃতার্থময়ীর মন থেকে হারিয়ে গেল, মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল একরাশ উৎকন্ঠা!
বেশ কিছুদিন পর একদিন সকালে নকড়ির ঘরের সামনে হাজির হয় এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী!সৌম্যদর্শন সেই সন্ন্যাসীকে করজোড়ে নমস্কার করতেই ! সেই সন্ন্যাসী দুশ্চিন্তাগ্রস্হ নকড়িকে বললেন," আনন্দের দিনে নিরানন্দ কেন বাবা?" নকড়ি কিছু বলার পুর্বেই সন্ন্যাসী বললেন," জানি, তোর সন্তানের কর্নকুহর রুদ্ধ আছে! আমি সেজন্যই এসেছি! সেই কর্নের রুদ্ধদ্বার খুলে দিতে! "সন্ন্যাসী শিশুর কানে মন্ত্র আওড়াতেই শব্দের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিতে লাগলো শিশু! সন্ন্যাসী যাওয়ার পুর্বে বলে গেলেন এই সন্তান বংশের সেরা হবে আর আজ থেকে এর নাম হবে ' অক্ষয় '!
এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে বড় হতে থাকে অক্ষয়! পাঠাশালায় পড়া! উপনয়নের পর বালক অক্ষয় গৃহদেবতা শ্রীধর নারায়নের মন্দিরে তন্ময় হয়ে ধ্যানে বসে থাকতেন! বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় শিয়ারসোল থেকে স্কুলের পাঠ শেষ না করেই ফিরে এলেন!
পুজা আর্চ্চা আর যজমানী করে গতানুগতিকভাবে অক্ষয়ের দিন কাটতে লাগল! একদিন গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে রক্তবাস পরিহিত এক সাধু বাড়ীতে উপস্হিত হয়ে অক্ষয়ের আতিথ্য গ্রহন করলেন! রাতে গ্রামবাসীকে শোনালেন ধর্ম কথা! সকালে প্রত্যাবর্তনের কালে অক্ষয়কে জানিয়ে গেলেন তিনি দেওঘরে বৈদ্যনাথ ধাম থেকে এসেছেন তাঁর আশ্রমিক নাম আত্মানন্দ গিরি! তিনি অক্ষয়কে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রন করে চলে গেলেন!
আবার দৈন্যন্দিন সাংসারিক কাজে ঢুবে থাকলেও তাঁর মন যেতে চায় দেওঘর! মাঝে মাঝে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে!
বৈশাখী পুর্নিমার দিন দেওঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হন অক্ষয়! নগ্ন পা, একটি লাঠির আগায় কাপড়ের পুটলি! পদব্রজে যাত্রা শুরু!কন্ঠে তাঁর শ্যামা সঙ্গীতের সুর!
. জিটি রোডের ধারে দুবচুরুরিয়া গ্রামের কাছে দীর্ঘ দেহী রক্তবাস পরিহিত সাধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়!সেই সাধু আর কেউ নন তন্ত্রসাধক, হিমালয় পরিব্রাজক, নাগা সন্ন্যাসী তুলসীদাসজী গোঁসাই! তিনি অক্ষয়কে গ্রামে ফিরিয়ে আনলেন এবং নির্দ্দেশ দিলেন শ্মশানে মা কালীর প্রতিষ্ঠা করার ! অগ্রাহয়ন মাসের অমাবশ্যায় ভিরিঙ্গী শ্মশানে কোমর বাঁধের পাড়ে তালপাতার পর্নকুটীরে পঞ্চমুন্ডির বেদীতে মা কালীর প্রতিষ্ঠা করে পুজা করলেন! কোমর বাঁধ থেকে বারি আনা হলো,শবদাহের অবশিষ্ট যঞ্জ সম্পন্ন হলো! দুর্গাপুরে এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো!
বর্তমানে পাঁচ বিঘা জমির উপর এই শ্মশানকালী অন্যতম তীর্থক্ষেত্র! তালপাতার পর্নকুটিরের স্হলে অক্ষয় রায়ের পুত্র মন্দির নির্মান করলেন! রবীন্দ্রনাথের পর তাঁর পুত্র সাধন কুমার রায় মন্দিরকে আরও সুসজ্জিত করলেন সেবামূলক কাজের সাথেও যুক্ত হলেন!
প্রতি বছর অগ্রহায়নের অমাবশ্যা তিথিতে মায়ের বাৎসরিক উৎসবে অগনিত ভক্ত সমাগম ঘটে! মায়ের পুরানো প্রতিমার নিরঞ্জন করে নতুন প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়! ওই দিন পুজা শেষে থাকে পংতক্তিভোজের আয়োজন ছাড়াও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্হা থাকে!ধর্মালো়চনাও হয়!
এই মন্দিরে রামকৃষ্ন মঠ ও মিশনের ভরত মহারাজ, সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সব্যসাচী মুখার্জী,স্বামী বিষ্নুপুরীজি,স্বামী রামেশ্বর পুরী,স্বামী বিবভানন্দজী, সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরু, প্রয়াত সাংসদ আনন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়,স্বামী লোকেশ্বরানন্দ প্রমুখ প্রতিথযশা ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours