স্বপন সেন, ফিচার রাইটার, হালিশহর:

চাষের জমিতে মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত।
 
অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর -এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। বর্গা বা ভাগ-চাষীরা এতে অংশ নেয়।
এর আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকদের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ-চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম পেতো। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দু'টোই কৃষক দিত। তিন ভাগ থেকেই আন্দোলনের নাম তেভাগা আর পূর্ব বাংলায় এর নেতৃত্বে ছিলেন বনেদি এক জমিদার বধূ ।

বৃটিশ সরকারের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল নগেন্দ্র সেনের গ্রামের বাড়ি ছিল যশোরের বাগুটিয়া গ্রামে। চাকরির কারণে পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকতেন। সেখানেই ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম হয় তার এক কন্যার । বড় হয়ে ভর্তি হলো বেথুন স্কুলে তারপর বেথুন কলেজে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটি খেলাধুলায় ছিল অসাধারণ।  সাঁতার, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন- সবেতেই ছিল সেরা। প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেবার আর অলিম্পিকের আসরই বসলো না। বিধাতা পুরুষের কিন্তু ইচ্ছা ছিল অন্যরকম, তাই হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে কলকাতা মহিলা সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে আন্দোলন শুরু করে চলে এলেন রাজনীতিতে। আঠারো বছর বয়সেই হয়ে গেলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য।

১৯৪৫ সালে বিয়ে হয় রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। পূর্ব বাংলার নাচোলের জমিদার বংশের ছেলে হয়েও কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন রমেন্দ্র। পর্দানশীন জমিদার বাড়ির বউ হয়ে এবার তাকে অনেকগুলো দিন অন্দরমহলেই কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর এক বন্ধুর উদ্যোগ তার জীবনে নিয়ে এলো পরিবর্তন।
উদ্যোগটি ছিল গ্রামের মেয়েদের শিক্ষাদান । মাত্র চারজন ছাত্রী নিয়ে স্কুল শুরু হলেও দ্রুত ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এভাবে গ্রামের মানুষের কাছাকাছি এসে সমাজসেবা শুরু করেন তিনি, জমিদারবাড়ির বধুমাতা থেকে অচিরেই হয়ে উঠলেন নাচোলের রানীমা। ‌

৪৭ এ দেশভাগের পরেও ওপারেই রয়ে গেল মিত্র পরিবার। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম লীগ ক্ষমতায় এসে কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় অনেক নেতাকর্মী। সবকিছু বাধা এড়িয়ে রাণীমা শোষিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়ালেন । জমিদারের গিন্নি হয়েও স্বামীর সাথে সামিল হলেন তেভাগা আন্দোলনে। পায়ে হেঁটে কাদা বন জঙ্গল পেরিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করতে লাগলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ সহ মোট ১৯টি জেলায় এই আন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভূমিমালিক স্বেচ্ছায় কৃষকদের তেভাগা অধিকার দিতে রাজি হন। ১৯৪৮-৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার আর পাঁচটা আন্দোলনের মতোই তেভাগা আন্দোলনকেও ভারতের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করে। 

প্রচন্ড দমন পীড়নের সামনে অবশেষে তাদের আত্মগোপন করতে হয় চন্ডীপুর গ্রামে। তেভাগা আন্দোলন চিরতরে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জ্বালিয়ে দেয়া হয় গ্রামের পর গ্রাম। হত্যা করা হয় প্রায় দেড়শো কৃষককে। চন্ডিপুর গ্রামে সাঁওতালদের একত্র করে তাদের ভেতর প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে তোলেন রাণীমা। চরের মুখে পুলিশ একদিন খবর পায় এখানে লুকিয়ে আছে তেভাগার বিদ্রোহীরা। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করতে আসে দুজন কৃষককে। প্রতিরোধে এগিয়ে আসে গোটা গ্রাম ।  ভয় দেখাতে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে মৃত্যু হয় এক কৃষকের। উত্তেজিত গ্রামবাসী তখন হত্যা করে ছয় জন পুলিশকে। 

এটার অপেক্ষাতেই  এতদিন বসেছিল পাক সরকার।  মিলিটারী দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো গোটা গ্রাম । আদিবাসী রমণীর ছদ্মবেশে জাল কেটে বেরিয়েও আসতে পেরেছিলেন রাণীমা, কিন্তু ছোট্ট একটি ভুলে শেষমুহুর্তে দলবলসহ ধরা পড়ে যান। 
সাঁওতাল নারী-পুরুষের সাথে তিনি কাছাকাছি রোহণপুর স্টেশনে পৌঁছেও যান। স্টেশনে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল দলটি। হঠাৎ এক সাঁওতাল নারী কোমরের কাছে শাড়িতে গোঁজা ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। পুলিশের চর কাছেই ছিল, হত দরিদ্র রমণীর কাছে ঘড়ি এলো কি করে ? নিমেষে ঘিরে ফেলে পুলিশ, ধরা পড়েন তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী নাচোলের রাণীমা ইলা মিত্র। ‌
গ্রেফতার করার পর তার ওপরে চলে অমানুষিক অত্যাচার, সেনাদের গণধর্ষণের হাত থেকেও রেহাই পেলেন না।

রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার চলাকালীন তার ওপর চলা অত্যাচারের বর্ণনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা আদালত। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার। মৌলানা ভাসানী সহ সাধারণ ছাত্র জনতা তার মুক্তির দাবিতে শুরু করে আন্দোলন। চাপে পড়ে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ঢাকা থেকে চলে আসেনন কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কংগ্রেস প্রথমে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হলেও রমেন্দ্র মিত্রের স্ত্রী হিসেবে নাগরিকত্ব প্রদান করে।
 
নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি ইলা মিত্র। ১৯৬৭ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত পর পর চারবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে CPI এর টিকিটে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাত্তরে  বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম।

জমিদার বাড়ির বধূ হয়েও কাটিয়েছেন সাদামাটা জীবন,নিজেদের জমিদারীর শত শত বিঘা জমি লিখে দিয়েছেন কৃষকদের নামে।  ২০০২ সালের তেরোই অক্টোবর কলকাতায় পরলোকগমন করেন। ‌


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours