নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

আমার উত্তম পুরুষ 
যাদু পুরুষ ! 
উত্তমকুমার .....
এই নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির নস্টালজিয়া, ভালোলাগা ও রোম্যান্সের শত শত কাহিনি।
এই মহানায়কের আজ জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মেছিলেন রূপালী পর্দার এই কিংবদন্তী। তাঁর আসল নাম ছিলো ‘অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়’। কর্মজীবনের শুরুতে বেশ ভালোই পরিশ্রম করতে হয়েছিলো তাঁকে। শুরুর বেশ কিছু ছবি ফ্লপ ছিলো তাঁর। পরে বসু পরিবারের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে জীবনের মোড় ঘুরে যায় উত্তমের। হয়ে উঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী। মহা নায়ক। সুপার হিরো!
 ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’… মোটর সাইকেলে উত্তম কুমার, পেছনে সুচিত্রা সেন। ‘সপ্তপদী’ সিনেমার সেই গান বাঙালি দর্শকের কাছে রোমান্টিক মুহূর্তের চিরন্তন দৃশ্য। প্রেমের পথে অহর্নিশ যাত্রার নায়ক-নায়িকা তারা। বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে এ চলা অনন্তহীন। সেই যাত্রাপথের উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক জুটি তাই দর্শকের হৃদয়ে পেয়েছে অমরত্বের মর্যাদা।
অনেকে বলেন বাঙালি দর্শক প্রেম করতে শিখেছে উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক দৃশ্য দেখে। বাঙালি দর্শকের কাছে রোমান্টিকতার একমাত্র উদাহরণ তারা।
আমারও তাই মনে হয় , এই এক পুরুষে আমার নানী থেকে মা , মা থেকে আমি , এখন দেখছি আমার মেয়েও বলছে হি ইজ কুল মম ! মরেছি
গো মরেছি ! 
ম্যাজিক ম্যান ! 
প্রজন্মের পর প্রজন্মের অন্তরে এক একটা বৃন্দাবন রচে যাচ্ছে মানুষটা , এজন্যই সেই উত্তম , সেই সে পুরুষ । পুরো প্যাকেজ এক বাক্সে তার ব্যক্তিত্ব, হাসি, উচ্চারণ- তার সম্পূর্ণ ভাবমূর্তিই। সাবেকি বাঙালি দর্শকের কাছে ছবিতে বৈষয়িক আতিশয্যের আবেদন ছিল না মোটেও , কোনটা থেকে কোনটা বলি , তার চাহনি চঞ্চল চোখের মনি নাচানো , ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির ছটা ,  ব্যাকব্রাশ চুলের স্টাইল , ফুলস্লিভ এলবো পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখা .. বুকের দুটো বোতাম খোলা , আহা আর হাসি , কন্ঠ  সাক্ষাত যেন নেশায় বুঁদ হয়ে স্রেফ টিভি বাক্সে তাকিয়ে থাকা । 
যৌবনে প্রথম ভিউকার্ড কিনে এই উত্তমকেই বুকে জড়িয়ে বেশুমার চুমু খেয়েছিলাম ,মনে আছে । কি ভালো লাগা সেই রেশ কাটে না এখনো , কি মায়া , কি ছায়া , ভালোলাগার আবেশে বয়ে বেড়াই । 
উত্তমের মুখ খুঁজে বেড়াই প্রেমিক পুরুষের মাঝে , স্টাইল খুঁজি , তাঁর বলবার , বসবার , তাকাবার , আলিঙ্গন করবার ভঙ্গি গুলো খুঁজে ফিরি ।
আমার দেখা হয় না রে  উত্তমের মতো কারো সাথে ।
এমন এলেমদার আছে নাকি কেউ ? 
কোথায় যেন পড়েছিলাম একবার -কোনো এক অনুষ্ঠানে উত্তমকুমারের নিরাপত্তার জন্য অনেক উঁচু মঞ্চ করা হয়েছিলো। মঞ্চে উঠে উত্তমকুমার দেখতে পান, এক নারী তাঁকে দেখার জন্য একটি বাড়ির কার্নিশ ধরে ঝুলছেন। তিনি তাকে নেমে আসতে বলেন। 
ওই নারী জানান তার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, কারণ তিনি তার স্বামীর ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু উত্তম কুমারকে দেখার জন্য।
বাহ ভাই ! একেই বলে “চাহাত কা বান্দা জাব আঁখো কে সামনে হোতে হেয় , তো জীবন কা কিয়া পারোয়া জাস্ট জি ভার কে তাঁক লো , আঁখ কা  মাজবুরি এইসে হি হোতে হে“। তবে উনি আরো একধাপ এগিয়ে ছিলেন মনের দাম দেবার বেলায় ......
শুনেছিলাম ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার পথে সমাজ, সংসারের কোনো বাধাই মানেননি মহানায়ক। লোকনিন্দা, অপবাদ সবকিছু মাথা পেতে নিয়েও জীবনের সতেরটি বছর একসঙ্গেই বসবাস করে গেছেন উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। আইনত বিয়ে করতে পারেননি কিন্তু বিবাহিত দম্পতির মতোই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত  ছিলেন তাঁরা।
একেই বলে উত্তম বাহাদুর পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া ! 
উত্তম খেতে ভালোবাসতেন আর সুপ্রিয়া রাঁধতে ... কি অসাধারণ রসায়ন বলুন তো ....শুনেছিলাম মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সেরা পথ নাকি পাকস্থলীর ভিতর দিয়ে। এটা সুপ্রিয়া দেবীর বেলায় খুব সত্যি। তাই নিত্য নতুন রান্না করতে ভালোবাসতেন তিনি। 
আর মহানায়ক ভালোবাসতেন সেসব খেতে। সুপ্রিয়ার হাতের রান্নার দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি। আমিও কল্পনায় কত কত রান্না করে তাল পাতার পাখা বাতাস করে বসে খাওয়াতাম ওকে । উত্তমের জন্য আমাকে ভালো রাঁধুনী হতে হয়েছিল , কারণ ভালো রান্না খাওয়ার পর উত্তম সুপ্রিয়ার হাতে চুমো দিতো ... এই লোভ কার না হয় বলুন । 
একটা মুগ্ধ চুমুর স্পর্শ আমি অনুভব করতাম ... ঘানির তেলে সর্ষে ইলিশ রাঁধার পর এমনটাই ভাবী আমি আজো
উত্তম এসে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে আমার হাত দুটো । আহা ! 
আচ্ছা বলুন তো কখনো এমন ঘটনা শুনেছেন কোথাও .. বেশ ভোজন রসিক ছিলেন কিন্তু তিনি , তাঁর প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিল রসগোল্লা। তবে তিনি রসগোল্লার উপর লবণ মিশিয়ে খেতেন বলে জানান মেকাপ শিল্পী কিশোর। সরাসরি চিনি এড়িয়ে যেতেই নাকি এমন কাণ্ড করতেন উত্তম কুমার। 
পাগল ও বটে।
তাই আজ ২১ বারের মতো অমানুষ দেখতে বসলাম .. টিভি স্ক্রিনে উত্তমের কপালে চুমু দিয়ে।
আমার উত্তম আমার জান ...
এই কথাটা সবসময় বলি দ্বিধাহীন বলি। 
হঠাৎ করেই আমি যখন একলা হয়ে যাই  , ছুটে যাই নির্জনতার কাছে । অনুচ্চারিত কথোপকথন হয় পাতার সাথে , বাতাসের সাথে , মেঘের সাথে। তখন কেবল একটি মাত্র মানুষ থাকে আমার পাশে । পরস্পরের ছায়া দেখি , ছায়ার ভেতরে এক ছবি , স্পর্শহীন এক ছোঁয়া ।  শুধু চারপাশ তার কথা , হাসি , এমন বুদ্ধি সম্মত ,রুচি সম্মত , সাবলীল কিন্তু স্তরীভূত, সরল কিন্তু তরল নয় । উইট , আয়রনি ও হিউমার মিশিয়ে  —- যে রসায়নটি তৈরি করেছেন  সিনেমার পর্দায় -হাজার নারী এবং পুরুষ হৃদয়ে , তা ছিল সত্যি অননুকরনীয়। অনুভবের গভীরতা প্রকাশ করবার সময় তিনি স্থিতধী চিন্তকের পরিবেশ বজায় রাখতেন । তিনি যখন প্ৰতিপক্ষকে নিশানা করেন তখন এক তির্যক ব্যঙ্গের কণ্ঠস্বর শোনা যায় । যা কখনোই সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় না । সেই ছোট বেলা থেকে আমি প্রথম যে পুরুষের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি সে উত্তম কুমার । বয়সের দোষ বললে ভুল হবে সেটা ছিল সময়ের দোষ । আমার আশে পাশে ফুপু - খালা , ভাবী- চাচী সবাই কেবল উত্তম কুমারের ছবি দেখতো ... সেই তখন থেকেই এমন একজন সুন্দর পুরুষের প্রেমে আমিও যে কুপোকাত । আমার পুস্পগন্ধ পুরুষ ... “ফুল মরৈ পৈ মরৈ ন বাসূ ... ফুল মরে কিন্তু তার গন্ধ মরে না“।

তথ্যসুত্র : উত্তমকুমার কে নিয়ে লেখা নানা পত্রিকা ও নেট থেকে পাওয়া ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours