চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়, ফ্রীল্যান্স রিপোর্টার, কলকাতা: 

ভারতে এখন সময় দেখা হয় আইএসটি মেনে, কিন্তু এর জন্মদিন কবে জানা আছে কি? 
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল। আর এর কিছুদিন পরেই ভারত আরও স্বাধীনতা পায়। সেটা হল নিজস্ব টাইম-জোন-এর স্বাধীনতা। যাকে আমরা এখন আইএসটি বলেই জানি। মানে ইন্ডিয়া স্ট্যানডার্ড টাইম। ভারতবর্ষে এখন এই আইএসটি মেনেই সময় নির্ধারণ করা হয় ।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ভারতে আইএসটি চালু করা হয়েছিল। এতে ঠিক হয়েছিল যে ভারত যে আইএসটি বলে টাইম জোন মেনে চলবে তা গ্রিনিচ মিন টাইম-এর থেকে ৫.৩০ঘণ্টা এগিয়ে থাকবে। মানে গ্রিনিচ মিন টাইম-এ কোথাও সকাল ৬টা বাজলে ভারতে তখন সময় হবে ১১.৩০টা।
'ডেলাইট সেভিং টাইম' বলে যে তত্ত্ব চালু আছে তা ভারতে প্রয়োগ হয় না। তাই গ্রিনিচ মিন চাইম মেনে চললে সঠিক সময় নির্ধারণ অসুবিধার মুখে পড়বে বলেই মনে করা হয়েছিল। আইএসটি মূলত নির্ধারণ হয় এলাহাবাদের মীরজাপুরের ক্লক টাওয়ার থেকে ৮২.৫ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ভিত্তিতে। এই মীরজাপুর ভারতে দ্রাঘিমা রেখার সবচেয়ে কাছাকাছি এলাকা। সেই কারণে ক্লক টাওয়ারকে এখানেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
কমন এরার চার শতকে অবশ্য ভারতে সময় গোনার পদ্ধতি একটু অন্যরকম ছিল। 'সূর্য সিদ্ধান্তে' বর্ণিত স্ট্যানডার্ড টাইম মেনে এই সময় গোনা হত।
বর্তমানে  উজ্জয়িনীর উপর দিয়ে আদ্য দ্রাঘিমা গিয়েছে বলে সূর্য সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে। ২৩ডিগ্রি ১১ ইঞ্চি উত্তর ও ৭৫ডিগ্রি ৪৫ ইঞ্চি পূর্ব দিয়ে উজ্জয়নের উপর দিয়ে এই আদ্য দ্রাঘিমা গিয়েছে বলে বর্ণিত করা হয়েছে । আবার রোহিতাকা, যার বর্তমান  নাম রোহতক-এও ২৮ ডিগ্রি ৫৪ ইঞ্চি উত্তর, ৭৬ডিগ্রি ৩৮ ইঞ্চি পূর্ব দিয়ে আদ্য দ্রাঘিমা যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল সূর্য সিদ্ধান্তে। এমনকী এই গ্রন্থে এটাও উল্লেখ করা হয় যে রোহিতাকা ও অবন্তি বিষুবরেখা ও উত্তর মেরুর লাইন বরাবর স্থাপিত।
প্রাচীন ভারতে এই সূর্য সিদ্ধান্ত মতে উজ্জয়নের আদ্য দ্রাঘিমা রেখায় সূর্যোদয় দেখে প্রাথমিকভাবে সময় গোনা হত। এরপর এই সময়কে গণিতিক আকারে ভেঙে ছোট ছোট সময়-এ ভাগ করা হত। তবে, সময় গণনাকে তখনকার দিনে শুধুমাত্র জ্যোতিষশাস্ত্রেই ব্যবহার করা হত। সে সময় বিভিন্ন রাজ্যগুলি হিন্দু ক্যালেন্ডার মেনে নিজস্ব স্থানীয়  সময়  নির্ধারণ করত। ১৭৩৩ সালে জয়পুরে যন্তর-মন্তর তৈরি করেছিলেন মহারাজা সোয়াই জয় সিং। যিনি সময় গণনার জন্য যন্তর-মন্তরে বড় ডায়ালের ঘড়িও লাগিয়েছিলেন।
১৭৯২ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি চেন্নাই-এ মাদ্রাজ অবজারভেটরি তৈরি করে। এরপর ১৮০২ সালে জ্যোতিষবিদ জন গোল্ডিনংহাম চেন্নাই লংঙ্গিটুড গঠন করেন। যা গ্রিনিচ মিন টাইমের থেকে ৫ ঘণ্টা এগিয়ে ছিল।
১৮৫০ সালে ভারতীয় রেলের জন্মের আগে পর্যন্ত দেশের ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোন কাজ চালিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু রেলের জন্ম হতেই দেশজুড়ে একই সময় গণনার দাবি উঠল। এক দেশ এক টাইমের দাবিতে সওয়াল হতে শুরু করেছিল। সমস্যা সমাধানে রেল এক অভূতপূর্ব ব্যবস্থার আমদানি করল। ১৯ শতকে রেল টাইম সিগন্যালের মাধ্যমে  বিভিন্ন রেল স্টেশনকে সূচনা দিতে থাকল সেখানকার স্থানীয় সময় অনুসারে কখন ট্রেন পৌঁছবে। টাইম-জোন-এর গণনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে অবশ্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। এর ফলে ভারতে টাইম জোনের আবির্ভাব ঘটেছিল, একটি কলকাতা ও অন্যটি মুম্বইয়ে ।
কলকাতার টাইম জোন গ্রিনিচ মিন টাইমের থেকে ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ও ২১ সেকেন্ড এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে মুম্বই টাইম জোন গ্রিনিচ মিন টাইমের থেকে ৪ ঘণ্টা ৫১ মিনিট এগিয়ে ছিল। ১৮৮৪ সালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে আন্তর্জাতিক মেরিডিয়ান কনফারেন্সে ইউনিফর্ম টাইম জোনস গঠনের দাবি ওঠে।
১৯০৫ সালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার স্ট্যান্ডাডাইজড টাইম জোনের নীতি গ্রহণ করে। এর জেরে এলাহাবাদকে এই নীতির আওতায় আনা হয়। কারণ, দেশের অন্যান্য জায়গার থেকে দ্রাঘিমার রেখার কাছে এর সর্বনিকট অবস্থান। ১৯০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এলাহাবাদে কাজ শুরু করে। কিন্তু, তার সত্ত্বেও কলকাতা ও মুম্বই টাইম জোন যথাক্রমে ১৯৪৮ সাল ও ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত কাজ করে গিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত  ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদের সময় গণনাকে আইএসটির মর্যাদা দেওয়া হয়। এবং তখন থেকে ভারত জুড়ে এই আইএসটি প্রয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। চেন্নাই থেকে সেন্ট্রাল অবজারভেটরি সেন্টারকে এলাহাবাদের মিরজাপুরে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই চালু হয়ে গেল আইএসটি বা ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours