Podobir atyoprokash
গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

বাবা মইদুল ইসলাম মা শর্বরী নট্ট সদ্যোজাত পুত্র সন্তানের নাম অভিযান, বাবা রফিউদ্দিন আহমেদ মা শর্মিলা ঘোষ মেয়ের নাম প্রথম প্রতিশ্রুতি,বাবা জিন্না আহমেদ মা পূর্ণিমা বন্ধ্যোপাধ্যায় ছেলের নাম নির্ঝর আলেখ্য ,জিন্না আহমেদ শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক দুই ভাইপোর নাম রদ্দুর আর দিগন্ত, দক্ষিণ দিনাজপুরের দৌলতপুরের বাসিন্দা মুজফ্ফর রহমান ও তার স্ত্রী সুজাতা চক্রবর্তী  তাদের দুই পুত্র সন্তানের নাম শমীক ও সাম্য তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু হিন্দু সমাজে এই পদবী বিড়ম্বনা,বর্ণভেদের কুপ্রভাব আর ধর্মীয় নিয়ম নীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে যদি জানতে চান এই পদবী অহং এলো কবে থেকে?  হিন্দু সমাজে কি সত্যযুগ থেকেই এই পদবীর প্রচলন ছিল?

আপনি কি জানেন রামায়নে রাম এর পদবী কি? মহাভারতে কৃষ্ণের পদবী কি? মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের পদবী কি ছিল?  বিশ্বামিত্র, দুর্যোধন, দশরথ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য এইসব মহামানবের নামের পর কি কোন পদবী বা টাইটেল ছিল? না এইসব কোন নামের শেষে কিন্তু কোনো  পদবী খুঁজে পাওয়া যায় না!!! তাহলে হিন্দু নামের পর পদবী ব্যবহারের প্রচলন হলো কিভাবে বা কবে?

 ইতিহাস বলছে সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী, ভট্টপদ সিংহ গিরি বল্লাল সেনকে শৈব্য মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে সনাতন ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন।                        এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত আনন্দ ভট্ট রচিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সম্পর্কে যে বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্য পাওয়া যায়:- (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ পনেরো বর্ষের বারোতম সংখ্যা, জুন 1999) গৌড়ের বৈদ্য  বংশীয় রাজা বল্লাল সেন  নিজের ধর্ম-পত্নী থাকা সত্তেও পদ্মিনী নামের এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিয়ে করেন অধিক বয়সে। আনন্দভট্ট লেখা থেকেই পাওয়া যায়:- "বিজয় সেনের জারজ পুত্র বল্লাল সেন ছিলেন দূস্কর্ম পরায়ন, সাধুপীড়ক এবং ডোম  চন্ডাল কন্যায় আসক্ত।" এর ফলে দেশজুড়ে বল্লাল সেনের সুনাম বিনষ্ট হতে শুরু হয় এবং তার কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে।
এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বল্লাল সেন সব সম্প্রদায়ের প্রজাদের নিয়ে এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, কিন্তু প্রায় সব সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন, রাজার এইসব কুকীর্তিকে সমর্থন করে ভোজ সভায় অংশ নিতে অস্বীকার করেন। এরপর বল্লাল সেনের তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে রাজ্যচ্যুত করেন এমনকি  তাদের সমস্ত চাকরী থেকে বরখাস্তও করে দেন। অন্যদিকে ভোজ সভায় অংশগ্রহণকারী বাকী সকল সম্প্রদায়কে পুরস্কারস্বরুপ কৌলীন্য বা পদবী (টাইটেল) প্রদান করেন। আর রাজ্যহারা  ব্রহ্মণেরা বিল , নদ-নদী ও জঙ্গল এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং বসবাস করতে থাকে, তাদেরকে বল্লাল সেন নমঃশূদ্র বলে

ঘোষনা করেন। নমঃশূদ্র শব্দটির দুইটি অংশ। নমো বা নমঃ শব্দের অর্থ প্রণাম বা অন্ন, আর শূদ্র কথার অর্থ ধর্মীয় চেতনা এবং সামাজিক কান্ডজ্ঞানহীন শ্রমজীবী মানুষ অর্থাৎ বল্লাল সেন নমঃশূদ্র শব্দের মাধ্যমে পরাজিত তবে

তবে প্রণাম পাবার যোগ্য শুদ্র ব্রাহ্মণেরা, এভাবেই বল্লালসেন পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে বিষাক্তবীজ বপন করেছিলেন। সেন রাজারা আদৌ বাঙালি ছিল না, পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে বাঙ্গালীদের শাসন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

পরবর্তী কালে এই জাত ও পদবী বৈষম্য একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। হিন্দু সমাজের পবিত্র

ঋগবেদের কিছু অংশের  বঙ্গানুবাদ:- "কর্ম ও গুনভেদে কেউ ব্রাহ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বৈশ্য কেউ শুদ্র, তাদের মধ্যে কেহ বড় নয় কেহ ছোট নয়, ইহারা ভাই ভাই। সৌভাগ্য লাভের জন্য ইহারা প্রযত্ন করে,  ইহাদের পিতা তরুন শুভকর্ম ঈশ্বর এবং জননীরুপ প্রকৃতি।"                          গীতায় আঠারো অধ্যায়ের একচল্লিশ নং শ্লোকে উল্লেখ আছে:- “মানুষের স্বভাব জাত-গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্ম সমূহ বিভক্ত করা হয়েছে"... অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে হিন্দু সনাতন ধর্মেও কিন্তু  স্বভাবজাত গুণ অনুসারে কর্ম সমূহ বিভক্ত করা হয়েছে, জন্ম অনুসারে মানুষকে বিভক্ত করা হয়নি।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours