Kojagori puja
নীলাঞ্জনা চৌধুরী, ফিচার রাইটার, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও শিল্পপতি, কলকাতা

কো জাগরি? ...... কে জেগে আছ?

শারদ পূর্ণিমার দিন, রাতভর ডেকে যান দেবী লক্ষ্মী। যিনি জেগে থাকেন, তাঁর সাড়া পেলে, তাঁকে দেন সৌন্দর্য, সুখ, সম্পত্তি, শান্তির বরদান।

সারা ভারতে শারদ পূর্ণিমায় নানাভাবে উৎসব পালিত হয়, এই দিনে লক্ষ্মীপুজার প্রচলন পূর্বভারতে, মুলত পশ্চিমবঙ্গ, ওডিষা, আসামে। পশ্চিম ভারতে আবার সারাদিন উপবাসের পর রাতে পূর্ণ চন্দ্রের জ্যোৎস্নার আলোতে খাদ্য গ্রহণ করে ব্রত উদযাপন করা হয়। শারদ পুর্ণিমার দিন চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় বিশ্বাস যে শারদ পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় অমৃত তত্ব থাকে। তাই , যে খাদ্যবস্তু এই আলোর সংস্পর্শে আসে তা অমৃত হয়ে যায়। সেই জন্য পূর্ব ভারতে বহু পরিবারে পূজার পরে দেবী লক্ষ্মীর প্রসাদী পায়েস, রাতে চাঁদের আলোয় রেখে দেওয়ার প্রচলন আছে।

লৌকিক দিক থেকে শরৎকাল, ফসল গৃহজাত করার সময়। বসন্ত কাল ও তাই । তাই এই দুই সময়ে হিন্দু দের মধ্যে দেবী পূজার প্রচলন আছে। হিন্দু বিশ্বাসে দেবী, হলেন প্রকৃতি মা, যিনি সম্বৎসর শস্য প্রদান করে তাঁর সন্তানদের লালন পালন করেন। দূর্গা পূজায় নবপত্রিকা রূপে শাকম্ভরী পূজা এই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন।

আমাদের বাঙ্গালী মানসে দেবী লক্ষ্মী, মহাদেব ও দেবী দুর্গা দুহিতা। আসলে হিন্দু শাস্ত্রমতে ব্যাপার টা অন্য।  শিবের কন্যা হিসেবে তাঁর উল্লেখ শাস্ত্রে নেই। শিব-পার্বতীর দুই পুত্র, আমাদের অতি পরিচিত দুই দেবতা কার্তিক এবং গণেশ ও এক কন্যা " অশোকসুন্দরী"। আসলে বাংলায় যে দুর্গাপূজা হয় সেখানে দেবীর দুই পাশে লক্ষ্মী দেবী ও দেবী সরস্বতীর অবস্থানের কারনে, আমাদের সাধারণ কল্পনায় তাঁরা দুর্গার দুই মেয়ে এবং সেই সুত্রে তাঁরা শিবেরও মেয়ে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দুর্গা পরিবারের এই তিন দেবী খুব সম্ভবত শ্রী শ্রী চন্ডীর মূর্তরূপ। এই সপ্তশতি স্তোত্রে দেবী তিন রূপে তাঁর মহীমা প্রকাশ করেছেন, মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। তাই মা লক্ষ্মী, শিবের কন্যা এ কথা লৌকিক বিশ্বাস, পৌরাণিক নয়। দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি সব এক দেবীরই নানা রূপ, এর মধ্যে দেবী দূর্গা হলেন রজোগুণী এবং সম্রাটের পূজিতা দেবী, বলা হয় দূর্গাপূজা হল অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতুল। তাছাড়া, শ্রী শ্রী চন্ডী সপ্তশতিতে দেবী মহিষাসুরমর্দিণী দূর্গা কে মহালক্ষ্মী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বিজয়া দশমীর ঠিক চারদিন বাদে লক্ষ্মীপূজা যেন দূর্গাপূজারই এক পরিশিষ্ট।

এর এক ঐতিহাসিক দিক ও আছে, আগেকার দিনে রাজারা বর্ষাশেষে শরৎকালে যুদ্ধযাত্রা করতেন, আর সেযুগে যুদ্ধ একদিক থেকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও ছিল বটে। পরাজিত রাজ্য থেকে ভূসম্পত্তির সঙ্গে আসত প্রভুত সোনাদানা, ধন সম্পত্তি। তাই এই সময়ে শক্তিদায়ীনি দেবী দূর্গার পরে, সম্পদদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর পূজা স্বাভাবিক ভাবেই সঙ্গত।

আমরা বর্তমানে যে সব দেব-দেবী দের পুজা করি, তাঁদের মধ্যে দেবী লক্ষ্মী অন্যতম প্রাচীনা। লক্ষ্মীদেবীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় “শ্রীদেবী” রূপে ঋক বেদে। এখানে লক্ষ্মী দেবী সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে পরিচিতা। বিখ্যাত “শ্রীসুক্তম”, এই ঋকবেদেরই অংশ। পরবর্তি কালে, অথর্ব বেদে তিনি ধন, সম্পদ, সৌভাগ্য, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বস্তুত, দেবীপূজার অনিবার্য অঙ্গ, আল্পনার প্রচলন সিন্ধুসভ্যতার সময় ও ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারনা। দেবী লক্ষ্মীর রূপকল্পনায় পাওয়া যায়্ তিনি চতুর্ভূজা, সুবর্ণবর্না, পদ্মপত্রাক্ষি, সর্বালঙ্কার ভূষিতা এবং তাঁর শাড়ীর রঙ কখনো লাল যখন তিনি উর্বরতা শক্তি প্রদায়িনী (মৃত্তিকা, বা পরিবার দুই ক্ষেত্রেই), কখনো সবুজ যখন তিনি শস্য ইত্যাদি প্রাচুর্যের অধিষ্ঠাত্রী এবং সাদা, যখন তিনি জ্ঞানদাত্রী। “শ্রীসুক্তম্‌” এ তাঁকে "সমুদ্ররাজ দুহিতা" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বেদের ভাষায় “সমুদ্ররাজ” কিন্তু বরুণদেব নন। পুরাণে সমুদ্ররাজ হিসেবে বরুণদেব বর্ণিত হন ও সেই হিসেবে পৌরাণিক ভাষায় বলতে গেলে তিনি বরুণদেবের কন্যা। তিনি শ্রীবিষ্ণুর পত্নি এবং কামদেবের মাতা।

লক্ষ্মী দেবী সারা ভারতে বহুরূপে পূজিতা, এর মধ্যে অষ্টলক্ষ্মীর পুজা বহু প্রচলিত। এই অষ্টলক্ষ্মী হলেন

১)“আদিলক্ষ্মী”- আদিলক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগু মুনির কন্যা। আবার কিছু পুরাণে এই দেবীকে সাগর কন্যা বলা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় প্রকটিত হয়ে ভগবান বিষ্ণুকে পতি রূপে বরণ করেন। আদি লক্ষ্মী বা মহালক্ষ্মী হলেন মা লক্ষ্মীর সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। এই দেবীর চারটি বাহু। এক হাতে পদ্ম, এক হাতে পতাকা, আর অন্য দুই হাতে অভয়মুদ্রা ও বরদা মুদ্রা।

২)“ধনলক্ষ্মী”- ধনলক্ষ্মী সোনাদানা, অর্থ ইত্যাদির প্রদায়িত্রী। এই দেবী প্রসন্না হলে সাধক কে অর্থ, ঐশ্বর্য এমনকি পারমার্থিক ধন সম্পত্তি ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করেন। ধনলক্ষ্মী দেবীর হস্তে শঙ্খ, চক্র, তির-ধনুক ও মঙ্গলকলস অথবা অমৃতকুম্ভ।

৩)“ধান্যলক্ষ্মী”- ধান্যলক্ষ্মী চাল, ডাল, ধান, গম ইত্যাদি কৃষিজ ফসলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই দেবীর কৃপায় কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠ ফসলে ভরে ওঠে। কৃষকেরা গৃহে ফসল তুলে লক্ষ্মীর মুখ দেখতে পান। মাঠ ভরা ধান, গম এই লক্ষ্মীর প্রতীক। ধান্যলক্ষ্মী দেবীর আটটি বাহু — দু’টিতে দুই পদ্ম, একটিতে গদা, একটিতে শস্য, একটিতে ইক্ষুদণ্ড, একটিতে অখণ্ড কলার কাঁদি ও বাকি দুই হাতে অভয় ও বরদা মুদ্রা।

৪) “গজলক্ষ্মী” - গজলক্ষ্মী পশু সম্পত্তি এবং পশু পালনের মারফৎ যে অর্থ আসে - তার অধিষ্ঠাত্রী প্রদায়িনী দেবী। পশুপালনের দ্বারা সভ্যতার বিকাশ, লাঙল, রথ টানা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের বিকাশ হয়েছিলো। এই দেবীর কৃপায় দেবতাদের রাজা ইন্দ্র দেব ঐরাবত বাহন রূপে প্রাপ্ত করেন। গজলক্ষ্মী রাজকীয় শক্তি প্রদান করেন। এই দেবীর দুই হাতে দুই পদ্ম, এবং বাকি দুই হাতে বরদা ও অভয় মুদ্রা। আর দুই পাশে দুই হস্তি।

৫) “সন্তানলক্ষ্মী” - সন্তানলক্ষ্মী সন্তান সন্ততি প্রদায়িনী দেবী। এই দেবীর কৃপায় সন্তান সুখ লাভ হয়। সন্তানলক্ষ্মী সন্তানের মঙ্গলকারিণী। এই দেবীর হাতে মঙ্গলকলস, ঢাল-তলোয়ার, অভয় ও বরদা মুদ্রা এবং দেবীর কোলে এক শিশু, হাতে তার পদ্ম। একটি হাতে তাকে যত্ন করে আগলে রেখেছেন দেবী।

৬) “বীরলক্ষ্মী” - বীরলক্ষ্মী যুদ্ধে সৌভাগ্য প্রদানকারী দেবী। এই দেবীর কৃপায় হতাশা, অলসতা ইত্যাদির নিরাময় ঘটে। নিস্কাম সাধকের মনে ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে যে সংগ্রাম হয় - তখন ইনি সাধক কে সাহস, উদ্যম, ক্ষমতা দিয়ে অধার্মিক রিপুগুলিকে ধ্বংস করবার শক্তি প্রদান করেন। বীরলক্ষ্মী অথবা ধৈর্যলক্ষ্মী দেবীর হাতে রয়েছে শঙ্খ-চক্র-তিরধনুক-ত্রিশূল অথবা তলোয়ার, তালপাতার পুথি অথবা অমৃত, অভয় এবং বরদা মুদ্রা।

৭) “বিজয়ালক্ষ্মী” - বিজয়ালক্ষ্মী যুদ্ধের পর বিজয়শ্রী প্রাপ্তকারিনী দেবী। সাধক যখন রিপুগুলিকে পরাজিত করে শুভশক্তির প্রকাশ ঘটান তখন তিনি যে পারমার্থিক সুখ লাভ করেন তা প্রদান করেন এই দেবী। বিজয়লক্ষ্মী, শুধুমাত্র যুদ্ধে নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই বিজয়প্রাপ্তির জন্য তাঁকে স্মরণ করা হয়। তাঁর হাতে শঙ্খ-চক্র-ঢাল-তলোয়ার-পদ্ম, পাশা, অভয় ও বরদা মুদ্রা।

৮) “ঐশ্বর্যলক্ষ্মী” - ঐশ্বর্যলক্ষ্মী সমৃদ্ধির প্রদায়িনী দেবী। তিনি সাধককে সকল রূপ ঐশ্বর্য প্রদান করেন। ঐশ্বর্যলক্ষ্মী দেবীর দুই হাতে পদ্ম এবং বরদা-অভয় মুদ্রা।

উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গজলক্ষ্মীর পূজা বহুল প্রচলিত। গজ লক্ষ্মীর মূর্তিকল্পে, দেবী চতুর্ভূজা, পদ্মহস্তা,পদ্মাসনা এবং দুদিকে দুটি হাতি স্বর্ণকলস দ্বারা তাঁর অভিষেক করছে। এ প্রাচুর্যের মুর্তিকল্প। তবে, পূর্ব ভারতে, দ্বিভূজা, পেঁচক বাহিনী লক্ষীর পুজাই প্রচলিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে শুঙ্গযুগ, গুপ্ত যুগ ও তার পরবর্তিকালে নানা মুদ্রায়, মন্দির উৎকিরণে কিন্তু দ্বিভূজা গজলক্ষ্মীর দেখা পাওয়া যায়।

পরবর্তী যুগে, বিশেষত বাংলায়, সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুজা অন্যতম মুখ্য উৎসবে পরিণত হওয়া, তৎকালীন সম্পদ সম্বৃদ্ধ নাগরিক সমাজ ও ব্যাপক বানিজ্য বিস্তারের দলিল। এই পূজায় ব্যবহৃত বহু উপচার সেযুগের বাঙ্গালীর আন্তর্জাতীক বানিজ্যে দাপটের প্রমান, যেমন এই পূজায় ব্যবহৃত কলাগাছের বাকলের তৈরি নৌকা। এরসঙ্গে  সাংসারিক শান্তি বিধায়ক, নানাবিধ রীতি নীতি, সঞ্চয়ের অভ্যাস ইত্যাদির প্রচলনের প্রচেষ্টা, দেবী লক্ষ্মীর পূজা ও ব্রতকথার রীতি ও কথার অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours