Amitav Bachchan er biswa bikhyeto dialogue
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"মেরে পাস মা হ্যায়।"

'দিওয়ার' সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ।

একদিকে অমিতাভ বচ্চনের গাড়ি, বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, সম্পদের ছড়াছড়ি। অন্যদিকে ভাই, পুলিস ইন্সপেক্টর শশী কপুর। সরকারি বেতনভূক এক কর্মচারী।

- তুমারে পাস কেয়া হ্যায়? অমিতাভের প্রশ্ন।

- মেরে পাস মা হ্যায়। শশী কপুরের ছোট্ট ওয়ান লাইনার।

ব্যাস চটাপট হাততালিতে ফেটে পড়লো গোটা হল।

আজও সেই ডায়লগের কথা মনে পড়ে যায়।

যখন দেখি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলেছে মেয়ে। কানে মোবাইল। আর মায়ের পিঠে মেয়ের ঢাউস ব্যাগ। অথবা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ছেলে। মা বাইরে বসে ছেলের অপেক্ষায়। হাতে ডাব। ডাবের জল খেয়ে ছেলে ঢুকবে সেকেন্ড হাফের পরীক্ষা দিতে।

"মেরা পাস মা হ্যায়!"

তারসঙ্গে আরেকটা কথাও মনে পড়ে। "রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি!"

কিন্তু 'মানুষ না করার' দায় নেবে কে? মা, কখনোই না। তাঁর যুক্তি, ছেলেমেয়েদের 'মানুষ' করার জন্য কুলির মতো ব্যাগ বয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে ঘেমেনেয়ে ডাব হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভালো খাইয়েছিলেন, ভালো পড়িয়েছি। আবার কী? তারপরও যদি মানুষ না হতে পারে, নিজেরা বুঝে করুক গে!

সেই দস্যু রত্নাকর কেস মনে নেই? পাপের ভাগ, অক্ষমতার দায় কেউ নেয় না।

কিন্তু কিছু কথা মা চেপে গেলেন, হয়ত নিজের অজান্তেই।

মায়ের প্রশ্রয়ে বোঝা বইবার জন্য সন্তানের কাঁধ তৈরিই হয়নি। সেই কাঁধ জীবনের বোঝা বইবে কি করে?

অক্ষমতার সেই জল যখন কোমর ছাপিয়ে মাথায়, তখন আচমকাই হিতোপদেশ- এবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো খোকা/খুকি!

মাথায় বাজ সেই আদরে আবদারে পালিত গিনিপিগ সন্তানের। বলেটা কী?

আর নিস্তার নেই।

যতই বলো না কেন- "মেরে পাস মা হ্যায়!"

পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর চলে আরেক খেলা।

- "আপনার ছেলে অঙ্কে কত পেয়েছে গো?"

- "আটানব্বই!" মারলেন ঢপ। "আপনার মেয়ের রেজাল্ট কেমন হলো?"

- "অঙ্কে আপনার ছেলের মতো নাম্বার পায়নি। তবে ইংলিশে একশোয় একশো!"

বাচ্চাদের সামনেই চলে মায়েদের এই 'বসে গুলবাজি' প্রতিযোগিতা। জীবনে মিথ্যা কথা বলার সন্তানের শিক্ষানবিশি শুরু, সম্ভবত ওই মা- মহল থেকেই।

"মেরে পাস মা হ্যায়!"

তবু কেন মশাই? কেন মায়ের এত গুণকীর্তন?

সন্তান কী এমন দোষ করলো?

ওই সন্তানের দৌলতেই তো 'মেয়ে' থেকে 'মায়ে' প্রোমোশন।

কথায় আছে, পুত্রার্থে ক্রিয়তা ভার্যা। নারীশরীর উর্বর মানবজমিন। স্বামীর দায়িত্ব সুকর্ষণের। জমির চরিত্র বিচার হয় ফলনে। বিয়ের পর বেশিদিন বাচ্চাকাচ্চা না হলেই তো শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, বাঁজাবউ। অশান্তির একশেষ। যেহেতু স্ত্রীর গর্ভেই সন্তানের আবির্ভাব, তাই প্রথম কোপটা পড়ে স্ত্রীর ঘাড়েই। এরপর নাহয় ওঝা, ডাক্তার, বদ্যি। আগে তো ওই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে যেত বরটাই। ঘরে ঢুকতো উর্বরা সতীন।

চাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়িতেও। আর সেই স্ত্রীর মানসিক অবসাদ সময়ের সঙ্গে চরমে পৌঁছয়। তাবিজ কবচ জ্যোতিষ মন্দিরে ঢিল ঝুলিয়ে মানত, কিছুই বাদ যায় না। চিড় ধরে সম্পর্কে।

এমন সময় হয়ত ডাক্তার জানালেন, অক্ষমতা স্বামীর। তাই স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার হচ্ছে না। এবার হয়ত স্ত্রীর দোষস্খলন হলো ঠিকই, কিন্তু তার উদ্বেগ কমে না। তাহলে কি তার মা হওয়া হবে না? মাতৃত্বের স্বাদে পূর্ণতা পাবে না নারীশরীর?

মুশকিল আসানের একটাই শর্ত, সন্তান। সেই সন্তান জন্মেই হাজারো ঝামেলা থেকে বাঁচায় মাকে। ফাটল ভরাট করে মা বাবা, স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্যের। অথচ ভাবখানা এরকম, সন্তান জন্ম দিয়ে মা যেন কৃতার্থ করলেন সন্তানকেই।

মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না। কেন?

সন্তানের কাছেই তো মায়ের ঋণী থাকার কথা। মা তার প্রয়োজন মেটাতেই, সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন। দশ মাস গর্ভে ধারণের ঋণ? আরে বাবা, সন্তান তার নিজের ইচ্ছায় টুক করে আপনার গর্ভে গিয়ে বসে পড়েছিল নাকি? স্বামী স্ত্রীর যৌনকর্মের ফসল সন্তান। আর কন্ডোম, কনট্রাসেপ্টিভ, আই পিলের জমানা মশাই। রীতিমতো ছক কষে তবেই গর্ভধারণ। ভ্রূণের আগমন। বাকীগুলোকে কন্ডোমে পুরে ফেলে দেন বাবা। অথবা কনট্রাসেপ্টিভ খেয়ে সন্তানের আসার পথে তালা ঝোলান মা।

"মেরে পাস মা হ্যায়!"

সন্তানকে কোলেপিঠে মানুষ করেন মা। চব্বিশ ঘণ্টার পরিচর্যা। ঠিক যেন চারাগাছ। বাইরের রোদ, জল, ঝড় থেকে তাকে আগলে রাখা। চারাগাছ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। ফুল ফোটে ফল ধরে। গৃহস্থ তার মর্জি মতো ফুল ছেঁড়ে, ফল পাড়ে। সেই ফুল সাদা চাদরে ঢাকা লাশের গায়ে উঠবে, নাকি ঈশ্বরের আসনে সমর্পিত হবে তা গৃহস্থের মর্জি।

ঠিক যেমন সন্তান বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে পড়বে নাকি এঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের জয়েন্ট এনট্রান্সে বসবে, তা ঠিক করে দেয় মা বাবা। সন্তানের একমাত্র পবিত্র কর্তব্য, মা বাবার উচ্চাশাপূরণ।

এখন বেশিভাগ ঘরেই এক ছানা। পোনাপালনের সামর্থ্য নেই। হাঁটতে শিখলেই স্কুল। কথা বলতে শিখলেই আবৃত্তি বা গান। গরু পিটিয়ে মানুষ করা আর কী। মা বাবার এই বেয়াড়াগিরি, সন্তানের শৈশব ছিনতাই নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। হাল শোধরায়নি।

যুক্তিতর্কের আতস কাচের তলায় মা বাবার ভূমিকাটা ফেলে দেখুন দেখি। গোটা ব্যাপারটার মূলে কী? সন্তানের উন্নতি নাকি মা বাবার নিছক স্টেটাস, উচ্চাশাপূরণ? প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, সন্তানের পছন্দ অপছন্দকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সন্তান জেহাদ করে বসলেই ধরনী রসাতলে গেলো।

সন্তানপ্রীতির নেপথ্যে আছে লিঙ্গ বৈষম্যও। কথাতে বলে, ছেলে মায়ের মেয়ে বাপের। ওই শিশুবয়স থেকেই মেয়েটিকে পাঠ পড়ানো হয়, দাদা, ভাইয়ের প্রথম ভাগ। ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম, মেয়ে বাংলা স্কুলে। বোন শেখে ত্যাগের পাঠ, ভাই শেখে দখলের পাঠ। পুরুষশ্রেষ্ঠ। কন্যাভ্রূণ খুনের দায় মাও কি এড়াতে পারেন? পুরুষপ্রধান সমাজব্যবস্থার কথা মনে রেখেই বলছি।

"মেরে পাস মা হ্যায়!"

মায়ের সুসন্তান ছিলেন শশী কপুর। অথচ মায়ের দুর্বলতা ছিলো বড় ছেলে অমিতাভ বচ্চনের ওপরেই। সম্পর্কের এই টানাপোড়েনে সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কেঁদে ভাসাতো মা।

"গঙ্গা আমার মা। পদ্মা আমার মা!"

নিরুপা রায়, সুলোচনার মতো কয়েকজন বিখ্যাত মা ছিলেন হিন্দি সিনেমায়। এঁদের সন্তানদের ওপর থেকে কিছুতেই যেন রাহুর দৃষ্টি সরতো না। দুঃখ আর দুঃখ। লাঞ্ছিতা মা, হেনস্থা সন্তান। ভিলেন কখনও হিরোর মাকে ধরে টান মারে তো কখনও হিরোইনকে ধরে। মায়ের চোখের জলে ভেসে যেত অডিটোরিয়াম। গোটা পরিবেশটা কাদা কাদা।

আসলে এই অশ্রুময়ী মা, জনমদুখিনী সীতা টাইপের চরিত্রগুলি আমাদের বড় প্রিয়। উচ্ছ্বল মহিলা, লড়াকু মা আমাদের ধাতে সয় না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সেই ছাপ আজও অম্লান।  আর তাই এই মহিলারাও নিজেদের অশ্রুসজল ছবিটাই তুলে ধরতে ভালবাসেন। কান্না মায়েদের পিছু ছাড়ে না।

এই মায়েদের জন্যই বলিপ্রদত্ত সন্তানরা।

কুসন্তান যদিও হয়, কুমাতা কখনও নয়।

"মেরে পাস মা হ্যায়!"
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours