Guru dokhina
স্বপন সেন, ফিচার রাইটার, হালিশহর: ‌

আম বাঙালির কাছে অচেনা এই ভদ্রলোক ছিলেন আজীবন শিক্ষাব্রতী। ১৮৯২ সালে জন্ম কলকাতায়।  গণিত এবং applied math দুটোতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯১৫ এবং ১৯১৮ সালে । শিক্ষকতা করার ইচ্ছা গোড়া থেকেই কিন্তু মনমতো প্রতিষ্ঠান পেলেন না বাংলায় । শেষমেশ অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে গেলেন সুদূর লাহোরে, আর্য সমাজের দ্বা্রা প্রতিষ্ঠিত সনাতন ধর্ম কলেজে।

অঙ্কের মতো নীরস বিষয়ের অধ্যাপক হয়েও , পড়ানোর গুণে অচিরেই জনপ্রিয়তা লাভ করলেন । সেই আমলেও ছাত্ররা ক্লাস ফাঁকি দিতো কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই বাঙালি স্যারের ক্লাসে উপস্থিতির হার ছিলো অসামান্য।

এলো ১৯৪৭, দুখন্ড হয়ে স্বাধীনতা পেল দেশ । লাহোর পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় ঐ কলেজটি উঠে এলো আম্বালায়। আমাদের অঙ্কের মাস্টার মশাইটিও সেই সাথে চলে আসেন এদেশে এবং ১৯৫৩ সাল অব্দি অধ্যাপনা করে অবসর নেন। শেষ বয়সে উনি চলে আসেন কলকাতায় এবং একাই অবসর জীবন কাটাতে থাকেন চিরকুমার এই মাস্টার মশাই।

ভাবছেন নিশ্চয়ই এক মামুলি শিক্ষকের কাহিনী, এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ফেসবুকে দেয়া কেন ? সত্যি বাঙালিদের ধৈর্য বড়োই কম। দাঁড়ান মশাই এখনও বলা শেষ হয়নি !

১৯৭৯ সালে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পেলেন পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর আব্দুস সালাম। দু'বছর পর ১৯৮১ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশের এই খ্যাতনামা বিজ্ঞানী কে দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদকে ভূষিত করার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। ডক্টর সালাম সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। এক চিঠিতে জানালেন যে বিশ্ববিদ্যালয় তার কৃতি শিক্ষককে কোনদিন সম্মানিত করেনি, তাদের থেকে পুরস্কার নিতে তিনি অপারগ!

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তো মাথায় হাত, কে ওনার শিক্ষক, তাও আবার পশ্চিমবঙ্গে । নাম তো ওনার কাছ থেকে জানা গেছে কিন্তু ধাম ? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন কেননা ডক্টর সাহেব ওনাকেও অনুরোধ করেছেন তার প্রিয় মাস্টার সাবকে খুঁজে বের করে সম্মানিত করতে।

শেষমেশ IB অফিসারদের অক্লান্ত চেষ্টায় দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়িতে মিললো তাঁর সন্ধান । তড়িঘড়ি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এক বিশেষ  Eminent Teacher Award এ সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিল এবং সেবছরই তাঁর হাতে তুলে দিলো সেই সম্মান । দুঃখের বিষয় সেই মাস্টার মশাই তখন শয্যাশায়ী ও চলশক্তিহীন । পুরস্কার প্রদানের সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে হাজির ছিলেন স্বয়ং ডক্টর সালাম। তিনি নোবেল পদকটি তার প্রিয় মাস্টারসাবের গলায় পরিয়ে দিয়ে আবেগ মথিত সুরে বলেছিলেন, কলেজে আপনার কাছে অঙ্ক না শিখলে এই পুরস্কার আমি কোনদিনই পেতাম না।

একজন অনামী শিক্ষকের প্রতি এক বিখ্যাত ছাত্রের এই উক্তি বুঝিয়ে দিল গুরু শিষ্যের সম্পর্কের মাঝে ‌দেশ কাল বা ধর্ম কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না ! জীবনে পার্থিব কিছু না পেলেও প্রিয় ছাত্রের কাছ থেকে এটুকু পাবার জন্যই যেন বেঁচে ছিলেন অধ্যাপক অনিলেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ছমাস পরে কলকাতাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পাঁচজন নয়.....ছজন , ডক্টর সালামের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সাথেও জড়িয়ে আছে আমাদের কলকাতা। ‌
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours