শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:
হাতজোড় করে এক যুবক আর্তস্বরে চিৎকার করে চলেছেন, 'আমরা ক্ষমা চাইছি, আমাদের ক্ষমা করুন, মানুষগুলোকে বাঁচান...।` উল্টোদিকে এই যুবকেরই প্রায় সমবয়সী কিছু তরুণ কঠিন মুখে বসে রয়েছেন একটি প্রত্যয় নিয়ে। এই আর্ত চিৎকারেও তারা সংকল্পবদ্ধ একথা ভেবে যে, এই অবস্থায় তারা যদি পিছিয়ে আসেন তবে নিজেদের কাছেই ছোট হয়ে যাবেন।
টেলিভিশনের পর্দায় দেখা এই ছবিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। এই একটি ছবিই বলে দিচ্ছিল যে, পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থা বাইরে যতই ঝকঝকে দেখাক, ভেতরে ভেতরে তা একেবারেই ধসে পড়েছে।
কলকাতার এন আর এস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ঘটে যাওয়া তান্ডবের রেশ এতোটা ছড়িয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক মহলেও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গুন্ডারাজ আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন দেশে-বিদেশে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে যেমন অনেক চিকিৎসক ইস্তফা দিয়েছিলেন, তেমনি গণ ইস্তফার পথেও হেঁটেছিলেন বহু চিকিৎসক। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে বহু সাধারণ মানুষ।
অথচ এমনটি হওয়া কখনোই অভিপ্রেত ছিল না। রুগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেদিন এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যে গুন্ডামি চলেছিল তা রীতিমতো অপরাধ। চিকিৎসকদের ক্ষোভকে যেমন অসঙ্গত বলা যাচ্ছিল না, তেমনি কতিপয় দুর্বৃত্তের জন্য সারা রাজ্যের চিকিৎসা পরিসেবা ভেঙে পড়াটাও কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য ছিল। কেননা এখনও অবধি এই রাজ্যে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে তাদের শোচনীয় অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটলো তা কিন্তু নয়। এর আগেও আমরা বহুবার এরকম ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। তবে এই জাতীয় অপরাধকে কোনোভাবে সমর্থন না ক'রেও কিন্তু একথা বলা যায় যে, বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের মানবিক মুখের অভাবও আমরা লক্ষ্য করি। যে প্রত্যাশা নিয়ে একজন রুগী বা তার পরিবার একজন চিকিৎসকের কাছে যান, তা পূরণ তো দূরের কথা, চিকিৎসকের অমানবিক মুখের জন্য হতাশা জাগে কেবল। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অযথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্যাথলজিকাল ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ, ওষুধ কোম্পানির কাছে কিছু পাওয়ার বিনিময়ে সে কোম্পানির ওষুধ বাজারে চালানো, নন-প্রাক্টিসিং ভাতা নিয়েও নিজস্ব চেম্বারে রুগী দেখা, বিনা কারণে রুগীকে দীর্ঘদিন ভর্তি করিয়ে রাখা, এমনকি রুগী নিয়ে আসার জন্য রিক্সাওয়ালাকে কমিশন দেওয়ার অভিযোগও অনেক সময় শোনা যায়। এসব অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন তাও নয়। মহান একটি পেশার মানুষের কাছে এরকম ব্যবহার ও অনৈতিক কাজ কখনোই প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু এ জাতীয় চিকিৎসকের জন্য সকলকে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। তাই, সাধারণ মানুষেরা আজও চিকিৎসকদের দেবতার মর্যাদা দেন। তাদের সামাজিক অবস্থানও অনেক উঁচুতে এবং তারা যে মর্যাদা পান, তা অন্য কোনো পেশায় পাওয়া যায় না। তাই সেই পেশার লোক আক্রান্ত হলে আমরা সকলেই ব্যথিত হই। আর এন আর এস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যা ঘটেছে তা তো এককথায় অপরাধ। যারা এই কান্ডটি ঘটিয়েছিল তারা সমাজের মূলস্রোতের কেউ হতে পারে না বলে বিশ্বাস করি। এরকম সমাজবিরোধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি কাম্য সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসলে আমরা একটি সার্বিক অবক্ষয়ের মধ্যে বাস করছি। প্রতিদিন নিজেরা হারিয়ে ফেলছি সহনশীলতা, শিষ্টাচার, সংযম, ভদ্রতা, নম্রতা। সমাজের সবচেয়ে উঁচুতলা থেকে একদম প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত এই অবক্ষয়ের ফল ভুগতে হচ্ছে গোটা সমাজকে। কুকথা, কুনাট্য, কুঅভ্যাস আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুঝিয়ে, কাছে আদর করে ডেকে বোঝানোর দিন বোধহয় গেছে। তাই কথায় কথায় 'চমকানো' আর 'ধমকানো'। এর থেকে বোধহয় আমাদের নিস্তার নেই আর। কেননা চিন্তার দীনতা আমাদেরকে দিনদিন গরিব করে তুলছে। স্বল্প জ্ঞানে অধিক চাইছি আমরা। আমরা কিন্তু কেউই সমাজের বাইরে নই। তাই যে সমাজ যেমন তার মানুষজনও ঠিক তেমনই হবেন। যদি আমরা তার চেয়ে বেশি কিছু আশা করি তবে তা বৃথা হবে, কেননা আমরা সেটা পাওয়ার উপযুক্ত নই।
যাহোক, চিকিৎসকেরা আবার পূর্ণ ও নব উদ্যমে কাজে নেমেছেন। আমরাও আমাদের সর্বপ্রকার সহযোগিতার হাত তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। আসলে চিকিৎসক-রুগী সম্পর্ক চিরদিনই অত্যন্ত পবিত্র। একজন রুগী যখন সুস্থ হয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন সেই চিকিৎসক যে আনন্দ পান তার মূল্য টাকায় হয় না। আবার চিকিৎসকের সামান্য সহৃদয় ব্যবহারে একজন রুগী যে স্বস্তি ও নির্ভরতা পান তা অনির্বচনীয়। এই সম্পর্কের গভীরতাকে কখনো কোনো মানদণ্ডেই মাপা যায় না। একদল সমাজবিরোধীর জন্য এই সম্পর্ক নষ্ট হবে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যদি তা হয় তবে আগামীদিন আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours