কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাক লড়াই বাঁধলে কী হবে?
দুমদাম করে পরমাণু বোমা ফাটবে নাকি ন্যাপাম বোমা?
কে জিতবে কে হারবে তা নিয়ে আমাদের আপাতত মাথা গরম না করলেও চলবে। কারণ অতীত আমাদেরই দিকে। সব সময়ই শেষ হাসি হেসেছিল ভারত। জয়ের হাসি।
কিন্তু পাকিস্তানও সমানে হেসে চলেছে। তা জানেন কি?
পাকিস্তানের হাসি, সুখের হাসি।
এ আবার কেমন কথা, তাই তো?
আসলে সুখী হওয়ার লড়াইয়ে গোহারা হয়ে বসে আছে ভারত।
আর পরাজয়ের কাঁটার মুকুট মাথাতেও দিব্য সুখে আছে পাকিস্তান।
সুখের মাপকাঠিতে ভারত পিছিয়ে। এটাই বাস্তব। আমাদের পেছনে ফেলে বেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে পাকিস্তান। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমীক্ষা এমনটাই বলছে।
বিশ্ববাজারে বড্ড আকাল সুখপায়রার। শুধু পৃথিবী নামের এই সুন্দর গ্রহটার, উষ্ণতা বেড়ে চলেছে তাই নয়। বরং বেড়ে চলেছে বিশ্ববাসীর অস্থিরতাও।
"সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও!"
কিন্তু কোথায়? লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক সিটি? নাকি মিসিসিপির পাড়ে বসে চিনাবাদাম খাবেন? আসলে সুখের কথা উঠলেই আমেরিকার চকচকে ছবিটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু সুখের ব্যারোমিটারে পারদ নামছে এই সুপার পাওয়ারেরও।
অতীতের আরেক সুপার পাওয়ারের কথা না তোলাই ভালো। এতটাই অধঃপতন হয়েছে রাশিয়ার।
পাওয়ার। পাওয়ার। পাওয়ার।
বিফলে গেল মোদির 'অচ্ছে দিন'
গলি মহল্লা থেকে রাজনৈতিক শিবির, সর্বত্র সর্বগ্রাসী শক্তির বুভুক্ষা। ভারতের অন্যান্য সব রাজ্যেই শক্তির আরাধনার চল। বাংলার পছন্দ ছিল মাতৃরস। আজ তাও বদলে গেছে। এখন টার্গেট, বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাই।
গোটা বিশ্বই আজ ব্যস্ত শক্তি সাধনায়। কিন্তু শক্তি বাড়লেই সুখ বাড়বে এমনটা নয়। তাহলে আজ 'দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট'- এর ইনডেক্সে এক নাম্বারে জায়গা হতো আমেরিকার। কিন্তু সে জায়গাটি ছিনতাই করে বসে আছে এমন এক দেশ, যার নাম চট করে আমাদের মুখে আসে না। ফিনল্যান্ড। সুখের স্বপ্নপুরী। 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট'- এ একেবারে প্রথমেই ছোট্ট দেশ ফিনল্যান্ডের নাম। উত্তর ইউরোপের এক দেশ। মানুষরা কথা বলেন সুইডিশ ভাষায়।
দেশটা দৈর্ঘ্য, প্রস্থে আমাদের পশ্চিম বাংলা থেকে প্রায় চারগুন বড়। আয়তন তিন লক্ষ আটত্রিশ হাজার চারশো চব্বিশ বর্গ কিলোমিটার। অথচ জনসংখ্যা ষোলো গুনেরও কম। মাত্র পঞ্চান্ন লক্ষ একুশ হাজার একশো আটান্নজন মানুষের বাস ফিনল্যান্ডে।
শুনলে চমকেও উঠতে পারেন, আমাদের স্বপ্নের সুপার পাওয়ার, আজকাল কথায় কথায় যার নাম আমাদের মুখে-মুখে, সেই আমেরিকার জায়গা ইনডেক্সের প্রথম দশটি দেশের মধ্যেও নেই। খানিকটা পিছিয়ে মার্কিন মুলুক আপাতত থিতু হয়েছে উনিশ নাম্বারে। আর অতীতে আমেরিকাকে টক্কর দেওয়া রাশিয়া আছে যোজন নীচে, আটষট্টি নাম্বারে।
সুখের এই মাপকাঠি তৈরি করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের 'সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক'। এই কাজে সাহায্য নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ আর স্নায়ুবিশেষজ্ঞদের। তবে ওই নীরস পরিসংখ্যানের কেমিস্ট্রিতে সুখের মাপজোক কষতে চাননি সমীক্ষকরা। তাই তাঁরা ব্যাপক কথাবার্তা চালান সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বুঝে নিতে চেষ্টা করেন, তাঁরা ঠিক কী চান। কিসে তাঁদের সুখ, আর অসুখই বা কিসে?
সমীক্ষায় কিছু অদ্ভুত তথ্য মেলে। যেমন, দেশের সরকারের কাছে ভারতীয়দের চাহিদা অপরিসীম। তাঁরা চায় অত্যাধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে পা মেলাতে। প্রত্যাশা বিলাস- ব্যাসনের। বিশ্বমানের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সব ইলেকট্রনিক গ্যেজেট। জীবনটাকে নিজের ইচ্ছে মতো বাঁচতে চাই আমরা। মানুষের এই অন্তহীন চাহিদাই কেড়ে নিয়েছে দেশের সুখ।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। ওই দেশের মানুষরা কিন্তু সরকারকে তেমন গুরুত্বই দেয় না। সেখানে বোলবালা ইসলাম মৌলবাদীদের। জাকির নায়ক, মাসুদ আজহারের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদীদের দাপাদাপি। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য হাতেগোনা কিছু মানুষের কাছে। ভারত, ইজরায়েল, আর মাঝেমাঝে আমেরিকাকে তাক করে, চোখা চোখা বাক্যবাণ ছুঁড়ে দেওয়া। তবু ওই পরিবেশেই পাকিস্তানিরা আহ্লাদে গলে জল।
শুধু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, প্রভাব প্রতিপত্তি বা সুস্থতা, এর কোনটাই সুখের উৎসমুখ নয়, মত সমীক্ষকদের। চাওয়া- পাওয়ার সমীকরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে অন্য কোনও কেমিস্ট্রি।
"যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই
যাহা পাই তাহা চাই না !"
মোট একশো ছাপ্পান্নটি দেশের নাম আছে এই ইনডেক্সে। গত মে মাসে এই রিপোর্ট হাতে আসে। রিপোর্টে ভারতের জায়গা একশো চল্লিশ নাম্বারে। আর পাকিস্তানের সাতষট্টিতে। কতই না হইচই! প্রাক্তন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির 'সুনহরে কাল'। মোদি সাহেবের 'অচ্ছে দিন'। গত বছরের 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট'- এও ভারত ছিল একশো তেত্রিশ নাম্বারে। এক বছরের মধ্যে সে নেমে এসছে সাত ধাপ। তার মানে ভারতীয়দের গ্রাস করছে হতাশা। বাড়ছে অসুখের মাত্রা। তাহলে কি মোদির 'অচ্ছে দিন'- এর উল্টো পথে হাঁটছে প্রয়াত রাজীব গাঁধির 'মেরা ভারত মহান'?
বড়ো লজ্জা! যখন শুনি, শুধু পাকিস্তান কেন, ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশীরাও আমাদের চেয়ে বেশি সুখে ঘর করছে। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো ছোট ছোট দেশগুলোর মানুষরাও বেশ ফুর্তিতে আছে। ইনডেক্সে এই দেশগুলোর জায়গা একশো পঁচিশ, একশো, একশো তিরিশ যথাক্রমে। চীন অবশ্য আরও এগিয়ে। তার জায়গা তিরানব্বইয়ে। এই হ্যাপিনেস চায়না মেড হলেও, আদৌ ঠুনকো নয়। প্রতিবেশীদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম আফগানিস্তান। তার জায়গা একশো চুয়ান্নতে।
সমীক্ষকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে কমপক্ষে দশটি দেশের উদ্বেগ ভয়ঙ্কররকম বেড়ে গেছে। আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সব রকমের চাপ বেড়েছে দেশগুলির ওপর। যার খেসারত দিতে তারা হু- হু করে ইনডেক্সের নীচে নেমে গেছে। ভারত ছাড়া এই দেশগুলির মধ্যে আছে ইয়েমেন, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলি।
সুখের প্রাবল্যে ভাটির টান লেগেছে আভিজাত্যে মোড়া ব্রিটিশ রাজেও। ইউনাইটেড কিংডম ছিল পনেরোতে। পড়ে গেছে উনিশে। তাহলে এরপরে কী? আগামী দিনে কি সুখের আমদানি, রপ্তানির কোনও প্রযুক্তি হাতে আসতে চলেছে?
এই আমদানি রপ্তানির কথাতেই অন্য আরেক প্রসঙ্গ মনে পড়ে গেল। বিশ্বের জঙ্গি রপ্তানি করার গোটা দায়িত্বটাই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে পাকিস্তান। সে মুম্বই হামলার ২৬/১১ হোক বা নিউইয়র্কের টোয়াইন টাওয়ার ধ্বংসের ৯/১১। নাটের গুরু কিন্তু সেই পাকিস্তান। কবিগুরু বলেছিলেন, মানুষ সুখে হাসে না। অপরের দুঃখে হাসে। হাসি মানেই অক্সিটোসিন। অক্সিটোসিন মানেই সুখ। পাকিস্তানের সুখী হওয়ার রহস্য কি এটাই?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours