Porokiya
উর্মি চক্রবর্তী, ফিচার রাইটার, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার:

১৮৬০ সালের পরকীয়া আইনকে চ্যালেঞ্জ করে যোশেফ সাইনের আনা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া রায় দেখে গেল গেল রব উঠেছিল চারদিকে। পাড়ার আড্ডা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়াতে চলেছিল ট্রোল।  হঠাৎ করে সবাই যেন জানতে বা বুঝতে পেরেছিলেন যে, পরকীয়া ভয়ঙ্কর ব্যাপার এবং সুপ্রীম কোর্ট এক ভয়ঙ্কর কান্ড করে ফেলেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের পক্ষে এই রায় হজম করা অত্যন্ত সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই মনে হচ্ছিল। 

কিন্তু কেন এই হইচই? আগে একটু দেখে নেওয়া যাক রায়তে কি বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি-সহ চারজন অর্থাৎ মোট পাঁচজনের বেঞ্চ একথা স্পষ্ট বলেছেন যে, পরকীয়া অসুখী বিবাহের পরিণাম হিসেবে আসে, অসুখী বিবাহের উৎস হিসেবে নয়। ফৌজদারি আইনের ভয় দেখিয়ে কাউকে একগামী করে রাখাটা ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে খর্ব করে। স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি নন, যে আইন ব্যক্তিমর্যাদা নারীর সমানাধিকারের বিরোধী, তা সংবিধানসম্মত নয়। পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছিল যে, পরকীয়ার কারণে স্বামী বা স্ত্রী কেউ আত্মহত্যা করলে এবং তাতে মদত দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং পরকীয়াকে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্র হিসেবেও দেখা যেতে পারে। 

সব রায় সবাইকে খুশী করবে তা কোনোদিনই হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই এই রায়কে কেউ স্বাগত জানিয়েছেন, কেউ জানান নি। কিন্তু জানান বা না জানান তাতে কিছু এসে যায় না। পরকীয়া নামক ব্যাপারটি প্রাচীন অতীত থেকে সমাজে বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। কোনো কোর্ট পক্ষে বা বিপক্ষে যেদিকেই রায় দিক না কেন পরকীয়ার কিছু যাবে আসবে না। বরং অদ্ভুত লাগে এটা ভেবে যে রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে হালের সর্বভারতীয় বা বাংলা টিভি চ্যানেলে পরকীয়া দেখে দেখে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত সমাজের নৈতিক বিবেকটি হঠাৎ জাগ্রত হল এবং তারা গেল গেল রব তুলে দিল। মুশকিলটা হল, বইয়ে পরকীয়া পড়া যায়, টিভির পর্দায় সপরিবারে বসে পরকীয়া দেখা যায়, দেবতার পরকীয়াকে 'লীলা' বলে মানা যায় কিন্তু পরকীয়া অপরাধ নয় বলা যায় না।

মনে রাখতে হবে একটা কথা, 'পরকীয়া অপরাধ নয়' আর 'পরকীয়া করো' এই দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সুপ্রীম কোর্ট কিন্তু পরকীয়া করতে বলে নি। পরকীয়াকে ফৌজদারী অপরাধ বলে গণ্য করাকে অসাংবিধানিক বলেছে। ভারতীয় সমাজে যেখানে আজও একটি মেয়ের বাড়ির বাইরে একা রাত কাটানোকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সেখানে এই গেল গেল রব অবশ্য অপরিচিত নয়। নারীকে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টা থেকে আজও ভারতীয় সমাজ পিছপা হয় নি। একজন পুরুষের বহুগামিতা ক্ষমা পেয়ে যায় পুরুষটির পরিবার বা সমাজের কাছে। কিন্তু নারী বহুগামী হলে তাকে 'নষ্টা' মনে করা হয়, তাকে ধর্ষণ করা যায় এবং তার ধর্ষণকে ছোটো-বড় নানা তকমায় দাগিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু কোন পরিপ্রেক্ষিতে একজন নারী বহুগামী হলেন বা পরকীয়াতে ব্যপ্ত হলেন তা কেউ অনুসন্ধান করেন না, যেমন অনুসন্ধান করেন না শারীরীক সম্পর্কে নারীটি পূর্ণ সন্তুষ্টি পেল কিনা, তার অরগাজম হল কিনা, শ্বশুরবাড়িতে সে তার যথাযোগ্য মর্যাদা পেলো কি না। সমীক্ষা চালালে এবং নারীরা সত্য কথা বললে গার্হস্থ্য জীবনের যে চিত্র উঠে আসবে তা নিশ্চিত প্রমাণ করবে অধিকাংশ বিবাহিত নারীই তাদের কাঙ্খিত সুখ বা শান্তি পান না কিন্তু সংসারটা ধরে রাখেন। কেন রাখেন? 

লোকলজ্জা, অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন না হওয়া, সমাজের রক্তচক্ষু, ডিভোর্সি নারীকে কে বিয়ে করবে জাতীয় ভাবনা ইত্যাদি কাজ করে এখনও। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে ডিভোর্সি পুরুষদের যত সংখ্যক কুমারী মেয়ে বিয়ে করে, ডিভোর্সি নারীকে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যায় কুমার পুরুষ বিয়ে করছে। নারীকে 'টাটকা' থাকতে হয়। সে দায় পুরুষের নেই। এরকম একটি সমাজব্যবস্থায় একজন নারী যদি  তার মানসিক শান্তির জন্য কোনো পুরুষের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন তবে তাকে কি খুব দোষ দেওয়া যায়? পরকীয়া বলতে আমরা যে পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ পাই তা যদি সেই সম্পর্কে না থাকে তবে কি তাকে অপরাধ বলা চলে? আবার শীঘ্রপতনের রুগী বা কোন বলবর্ধক বা লিঙ্গবর্ধক তৈল ব্যবহারকারী স্বামীর স্ত্রী যদি শরীরের সুখের জন্য কখনো তথাকথিত 'বিপথগামী' হন তবে তাকে খুব দোষ দেওয়া যাবে? পুরুষের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য নয়?  যদি না হত তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে 'আবোলতাবোল মেসেজ করলে ব্লক করতে বাধ্য হব' জাতীয় স্ট্যাটাস নারীকে দিতে হত না। রমরম করে চলতো না যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে পর্নো ওয়েবসাইটগুলি।

নারী ও পুরুষের বন্ধুত্ব হতে পারে এই ধারণাটিই আমাদের নেই। কেননা ঘোমটার ভেতর খেমটা নাচ আমাদের মজ্জাগত। আমরা সেটাই ভালবাসি। ঘোমটা সরে গিয়ে মুখটি দেখা গেলেই সব ভালমানুষের পো হয়ে যাই। দীর্ঘদিন ধরে লালিত এই (কু)সংস্কার যদি না অচিরেই দূর করতে পারি তবে যুগান্তকারী রায়টিকে বুঝতে কোনোদিনই পারবো না। আবারও বলছি পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয় গণ্য হবার সাথে সাথে আমাদের চেনাজানা নারীটি বা পুরুষটি পরকীয়ায় মত্ত হয়ে উঠবে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। কারো পরিস্থিতি যদি তাকে সেদিকে টেনে নিয়ে যায় তবে যে কোনো অবস্থাতেই পরকীয়া হতে পারে। দৃঢ়ভাবে আজও বিশ্বাস করি বাঙালি-সহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কমবেশী সকল ভারতীয়ই বিবাহ নামক বস্তুটির ওপর ভরসা করে বাকি জীবন সসম্মানে সুখে শান্তিতে কাটাতে চায়। পরকীয়ার স্থান সেখানে থাকে না। কিন্তু ওই যে...পরিস্থিতি। তার চাপটা এমনই যে কখন কি হয়ে যায় তা আগাম বলা সম্ভব না। এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোন নারী বা পুরুষ পরকীয়াতে শান্তি খুঁজে পেলে অসুখী সেই মানুষটিকে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার অধিকার রাষ্ট্র বা সমাজ বা ব্যক্তি কারোরই নেই। 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours