ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ 
রূপেন্দ্র  অবাক  হয়ে  গেলেন!  ফরাসীডাঙায়  বসে  দেওয়ান  ইন্দ্রনারায়ন  কি  করে  জানলেন  নগেন দত্তের  পরিবারের  গোপন কথা? তাঁকে  কিছু  বলার  সুযোগ  না  দিয়েই  ইন্দ্রনারায়ন  দরজার  আড়ালে  থাকা  তুলসীকে  উদ্দেশ্য করে  বললেন," মা  জননী  বাইরে  কেন? ভেতরে  এসো! তুলসী  ঘরে প্রবেশ  করে, প্রথমে  জগন্নাথ  তর্কপঞ্চাননকে  প্রনাম  করে   পরে  ইন্দ্রনারায়ন  সহ  সকল  ব্রাক্ষ্মনকে  প্রনাম  করলেন! তাকে  ইন্দ্রনারায়ন  দায়িত্ব দিলেন,  অন্দরমহলে  গিয়ে  তার মা (ভবতারনের  স্ত্রী) এবং  জেঠিমা  অর্থাৎ  ইন্দ্রনারায়নের  স্ত্রীকে  খুঁজে  বের  করা! বাচস্পতি মশাই  তাঁদের  দুই  পরিবারের  মহিলাদের  একটি  পৃথক  কক্ষে  পংতিভোজের  ব্যবস্হা  করে  দেবেন!
       ইন্দ্রনারায়নকে  জগন্নাথ  আগেই  ভাবতারনবাবুর  ক্রোধের  বিষয়টি  জানিয়ে  রেখেছিলেন  এবং  এটাও  জানিয়েছেন
ভবতারনবাবু পন  করেছেন  শ্রাদ্ধ বাড়ীতে  অন্নগ্রহন  করবেন  না!
            ইন্দ্রনারায়ন  বাচস্পতি মশাইকে  উদ্দেশ্য  করে  বললেন, তাঁর  আর  গাঙ্গুলী পরিবারের  পৃথক  আহারের  ব্যবস্হা করতে !
      ভবতারন  গুম  হয়ে  বসেছিলেন! এবার তিনি ইন্দ্রনারয়নকে জানালেন, তিনি  এখানে  অন্নগ্রহন করতে  পারবেন  না! কারন  জগন্নাথ  তর্ক পঞ্চানন  তার  সাথে  দুর্ব্যবহার  করেছেন!
     ইন্দ্রনারায়ন  ভবতারনকে  বললেন," ভবতারন তুমি  চানক্যের  একটা  মূল্যবান  শ্লোক  ভূলে  যাচ্ছো!"স্বদেশে  পূজ্যতে  রাজা, বিদ্বান  সর্বত্র  পূজ্যতে! ফরাসীডাঙার  বাইরে  নায়েব  ভবতারন  গাঙ্গুলীকে  কেউ  চেনে  না! আর  গৌড়ের  বাইরে  দেওয়ান  ইন্দ্রনারায়নের  নামটাও  কেউ  তিনি না! কিন্তু  নগ্নপদ  এই  টুলো পন্ডিতকে  আসমুদ্র হিমাচল , কাশ্মীর  থেকে  কন্যাকুমারিকা  প্রতিটি  জমপদের  পন্ডিতসমাজ  ওঁকে চেনেন!ওঁনার  নাম  শুনলে  প্রনাম জানাবেন! আর  শতবর্ষ পরেও  কোন  সময়ে  গৌড়বঙ্গে  যদি  তোমার  আমার  নাম  কখনো  কাদাচিৎ  উচ্চারিত  হয়, সেটা আমাদের  কর্মের  জন্য  হবে  না!হবে  আমরা  দুজনে  এই  নগ্নপদ  নগ্নগাত্রের  মহাপন্ডিত  জগন্নাথ  তর্কপঞ্চানেনর  সমকালের মানুষ  ছিলাম  বলে! তুমি চন্ডাল  ক্রোধের  বশে 
এমন  একজন  মহান  ব্যক্তিত্বকে  মহা  পন্ডিতকে  অপমান  করবে  আর  আমি  সেটা  দেখব?
       ভবতারন  নিচু স্বরে  নরম  হয়ে  অনুযোগ  করলেন, কিন্তু  আমার  নাতনি হটীকে  উনি কায়দা  করে  অপহরন  করলেন!
       
          ভবতারন  প্রায়  গর্জে  উঠলেন, কন্যাকে  মানুষ করা  দুরঅস্ত , কন্যাকে  রাখবে  কোথায়? চালচুলোহীন,কপর্দকশূন্য ব্রাক্ষ্মনের  নিজের  অন্নসংস্হানের  স্হিরতা  নেই! কন্যাকে  কি  খাওয়াবে?
             ইন্দ্রনারয়ন  রূঢ়ভাবে  বললেন," ভদ্রভাবে  যদি  কথা  বলতে  না  পারো  তাহলে  আমাকে  অন্য কিছু  ভাবতে  হবে! আবার  বলছি, ওই  দুর সম্পর্কের  নাতনির  উপর  তোমার  কোন  অধিকার  নেই! আর  একটা  কথা, তুমি  তর্কপঞ্চানন কে  বাহুবলের  ভয়  দেখিয়েছো  শোন, এটা  আমি  বরদাস্ত  করবো
না !এব্যাপারে  তুমি  আমার  কোন  সাহায্য  পাবে  না  বরং  আমি  বিরূদ্ধে  থাকবো!
আর  আজ  থেকে  হটী  তার  বাবার  আশ্রয়ে থাকবে! ভষগাচার্যের  বাড়ী  না  থাকলে, তারা  গাছ তলায়  বা  মন্দিরের  চাতালে  শয়ন  করবে, পিতাপুত্রী  শাকান্ন খাবে, অথবা  উপবাস  করবে! তুমি  এব্যাপারে  আর  মাথা  গলিয়ো  না, তার  ফল  ভাল  হবে  না!
         গুম হয়ে  রইলেন  ভবতারন!
জগন্নাথ  তর্কপঞ্চানন  তুলসীকে  পাশের  ঘরে  নিয়ে  গিয়ে হটীকে তার  হাতে  সমর্পন  করে  বললেন, " হতভাগীটা  জন্মের  সময়  একবার  মা  হারিয়ে  তোকে  পেল  , কিন্তু  একবগ্গা  বাপটার  জন্য  আবার  মাতৃহারা  হলো! আজ  মা  মেয়ে  দুজনতেই  সে  বরন  করতে  পারতো! কিন্তৃ়ু  মহাজেদীটার  এক কথা! হিন্দুধর্মে  যদি  বিধবা  দ্বিতীয়বার  বিয়ে  করার  অধিকার  না  পায়, বিপত্নিক  কেন  দ্বিতীয়বার  বিয়ে  করতে  পারবে! যাই  হোক  তুই  ওর  বাপের  কোলে  মেয়েটাকে  তুলে  দিবি!
         তুলসী তর্কপঞ্চানন  ঠাকুরকে  অনুরোধ  করলেন, তিনি  যেন তাঁর  কোন  শিষ্যকে  তাঁর  কাছে  চিঠি  দিয়ে  পাঠান! তাঁর  হাতে  তার  দিদি  কুসুমমঞ্জরীর  বিয়ের  যৌতুকে  পাওয়া গহনাগুলি  পাঠিয়ে  দেবে! এগুলি  সে  তার  জামাইবাবুকে  দিতে  চেয়েছিল! কিন্তু  তিনি  নেননি! বলেছিলেন, হটীর  বিবাহে  যৌতুক  দিতে! হটী  যখন  তার  বাবার  কাছে  যাচ্ছে  তখন  অলঙ্কারগুলি  প্রত্যার্পন  করাই  শ্রেয়!
তুলসীকে  অপেক্ষা করতে  বলে  তিনি  রূপেন্দ্রকে  দিলা  কাছে  পাঠালেন! হটী  ঘুমন্ত  হটীকে  তাঁর  হাতে  সমর্পন  করে  বলল "আপনি   মা সহ  কন্যাকে  গ্রহন  করতে  সন্মত  নন  তাই  এই  নিন, আপনার  বুক  জড়ানো  ধন!"
         খুব  যত্নকরে  রূপেন্দ্র  তাঁর  ঘুমন্ত  কন্যাকে  শ্যলিকা  তুলসীর  হাত  থেকে  গ্রহন  করলেন! তারপর  অনুযোগের  সুরেই  বললেন," তুমি  তো  জানো  তুলসী  কেন  আমি..."
তাঁকে  থামিয়ে তুলসী বলল, " না  না  কোন  ব্যাখ্যা   দেওয়ার  প্রয়োজন  নেই! আপনার  মত  যখন  কোন  বিধবার  দ্বিতীয়  বিয়ের  অধিকার  নেই  বিপত্নীকের   কেন থাকবে?
     আমার  জিজ্ঞাস্য, যতদিন  সতীদাহ  প্রথা  বন্ধ  হচ্ছে না , ততদিন  বিপত্নীকরা  কেন  স্ত্রীর  সাথে  সহমরনে  যাবে না ?
     এসব  কৌতুক  থাক  হয়তো  আর  কোনদিন  আমাদের  দেখা  হবে  না! আজ  যা  ঘটল  এরপর  ফরাসীডাঙার  দরজা  আমার  জন্য  চিরকালের  জন্য  বন্ধ  হয়ে  গেল, কথাগুলো  এক  নিঃশ্বাসে  বলল, রূপেন্দ্র!
    জামাইবাবু, কে  বলল  দেখা হবে  না? আমার  বিয়ের  পর  আমার  স্বামীর  সাথেই  সোঁয়াই  তীর্থে  যাবো! সেদিন  বাবার  বাধা  দেওয়ার  কোন  অধিকার  থাকবে  না! আর  সেদিন  যাবো  আজ  তোমাকে  যা  ফিরিয়ে  দিলাম  তা  কড়ায়  গন্ডায়  ফেরৎ  নিতে!
       রূপেন্দ্র  অবাক  বিষ্ময়ে  তুলসীর  দিকে তাকিয়ে  রইলো!তার  বাক্যস্পুর্তি  হলো  না!
   মাটির দিকে  চেয়ে  তুলসী  বলল," দিদির  জীবনে  যে  দুর্ঘটনা  ঘটেছে  তা  আমার  জীবনে  ঘটতে  দেবো  না!আপনি  শুধু  আমার  ভগ্নীপতিই নন, একজন  ভেষগাচার্য! আমার  প্রসবের  সময়  কোন  সঙ্কোচ  না করে  আপনার  কাছে  চলে  যাবো! আজ আমার  বুকজোড়া  ধন  আপনার  হাতে  তুলে  দিলাম! সেদিন  আপনি  আমাকে  ফেরৎ  দেবেন!
      
ইন্দ্রনারায়ন  কড়া  স্বরেই  বললেন, তুমি  কি  বলতে  চাইছো  ভবতারন? পন্ডিত  মশাই  তোমার  নাতনিকে  অপহরন  করেছেন? বরং  তুমিই  অন্যায়ভাবে  তোমার  দৌহিত্রীকে  আটকে  রাখছিলে! সেটা  সামাজিক  ও নৈতিক  অন্যায়! সংস্কৃতে  একটা  শ্লোক  আছে," পিতা  রক্ষতি  কৌমারে.. " অর্থাৎ  অনূঢ়া  কন্যকে  রক্ষা করা  লালন পালন  করা  তার  পিতার  দ্বায়িত্ব, অন্য  কারো  অধিকার  নেই  ! কন্যার  দ্বায় দায়িত্ব সম্পর্কে কোন  কথা  বলার! তুমি  তো  পিসশ্বশুর  তোমার  তো  কোন  অধিকারই  খাটে  না!তোমার  বিবাহে  আমার  নিমন্ত্রন  থাকবে না, এটা  নিশ্চিত! কিন্তু  তোমার  সন্তানকে  সুস্হভাবে  পৃথিবীতে  আনার  সৌভাগ্য  থেকে  আমাকে  বঞ্চিত  করো  না!
      তুলসী  রূপেন্দ্রকে  প্রনাম করে  সন্মতি  দিল!
(চলবে)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. ঐতিহ্যের আলোয় দুর্গাপুর ৭৫ পড়লাম।
    অত্যন্ত আবেগঘন হয়ে মনে গেঁথে বসছে।
    লেখক ভবানী ভট্টাচার্যকে অনেক ধন্যবাদ এই ইতিহাস আর এলাকাকে একসাথে সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য।

    ReplyDelete