মুজতবা আল মামুন, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
রাজ্যে
গণপিটুনি বন্ধে বিল পাশ হয়েছে সদ্য। তারপরই যেন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মত করে,
গণপিটুনিতে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো মুর্শিদাবাদের আবদুল খাবিরকে। পেশায়
রাজমিস্ত্রি খাবিরকে কী অভিযোগে পিটিয়ে মারা হলো, তাও এক ডাক্তারের
চেম্বারে ? ভয়ে খুব বেশি মুখ খুলছে না স্থানীয় মানুষ। আসামিরাও তা জানান
নি। রাজ্য সরকারের তরফ থেকেও বিষয়টা চেপে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ খাবিরের
পরিবারের। গ্রেফতার করা হয়েছে ডা এ কে ঘটকের চেম্বার যে বাড়িতে, তার
মালিক অশোক বড়াল ও ডাক্তারবাবুর সহকারি রণজিৎ বিশ্বাসকে। এরা দুজন ঘটনা
ঘটিয়েছে বলে স্থানীয় মানুষ জানিয়েছে।
গণপিটুনিতে
নৃশংস ভাবে হত্যা করার বিরুদ্ধে গোটা দেশ যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছে,
রাজস্থান সরকার এর বিরুদ্ধে বিল পাশ করিয়েছে, এই বাংলাতেও সদ্য বিল পাশ
হলো, ঠিক সেই সময়কালে গত ৪ সেপ্টেম্বর পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে গেল
মুর্শিদাবাদের সদর বহরমপুরে। ওইদিন দুপুর ১২ টা নাগাদ বহরমপুরের লালদিঘী
এলাকায় ডাঃ এ.কে ঘটকের চেম্বারে পিটিয়ে হত্যা করা হল ৩১ বছরের আব্দুল
খাবিরকে। আবদুল খাবিরের বাড়ি বহরমপুর ব্লকেরই শাহাজাদপুর গ্রামে। পেশায়
তিনি রাজমিস্ত্রী। ভালোমানুষ বলে তার পরিচয় ছিল। খাবির তিন কন্যার বাবা।
এই ঘটনায় যে ঘরে ডাঃ ঘটকের চেম্বার সেই ঘরের মালিক অশোক বড়াল এবং ডাক্তারের
সহায়ক রণজিৎ বিশ্বাসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ । আবদুল খাবিরের স্ত্রীর
আকলিমা বিবি জানান, গ্রামেরই একটি বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়েছিলেন
তার স্বামী। দুপুর ১ টা নাগাদ একটি অজানা ফোন থেকে তাকে জানানো হয়,
খাবিরকে মারা হয়েছে ডাঃ ঘটকের চেম্বারে। আকলিমা কয়েকজন লোক নিয়ে সঙ্গে
সঙ্গে ঘটনাস্থলে আসেন। সেখানে এসে শুনতে পান, লাশ পুলিশ নিয়ে চলে গেছে
পোস্টমর্টেম করার জন্য। স্থানীয় মানুষের দাবি তাকে হাত-পা বেঁধে চেম্বারের
মধ্যে মারা হয়েছে।
এই
পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে এবং ডাঃ এ. কে ঘটকের গেপ্তারের দাবিতে কিছু
সংগঠনের পক্ষ থেকে উত্তর পাড়া মোড়ে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। অবশেষে
জেলা পুলিশ ডাঃ ঘটককে গেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয় ।
এখানে
পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যে পুলিশকে ডেকে পাওয়া যায় না, ডাকলে
তাদের আসতে বেলা গড়িয়ে যায়, সেই পুলিশ কী করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে
পৌঁছলো ? দ্রুত লাশ তুলে নিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে দিল ? মৃতের পরিবারকে
খবরটুকু পর্যন্ত দিল না কেন ? ডা এ কে ঘটক এবং বাড়িমালিক প্রভাবশালী বলে
?
রাজস্থানের কংগ্রেস
সরকারের পর, সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় গণপিটুনি বিরোধী বিল পাশ করেছে
তৃণমূল সরকার। মহম্মদ আখলাক, ইন্দ্রজিৎ দত্ত, দিল্লির চিকিৎসক পঙ্কজ নারঙ্গ
থেকে সম্প্রতি তবরেজ আনসারির মৃত্যু হয়েছে গণপিটুনিতে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ এই
পাঁচ বছরে মোদী সরকারের রাজত্বে ভারতে গণপিটুনি বেড়েছে অনেকটাই। কখনও গরু
মাংস রাখার ‘অপরাধে’, আবার কখনও মহরমের চাঁদা দিতে না পারার ‘অভিযোগে’
গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে সাধারণ ভারতীয়র। তার মধ্যে দু-একজন বাদে, বেশির
ভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এই গণপিটুনি চালু করেছে সঙ্ঘ পরিবারের
পালনপোষনে সমৃদ্ধ হওয়া নানান উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এই গণপিটুনি প্রবল
আকার নেওয়ায়, প্রধানমন্ত্রী নাম কা ওয়াস্তে বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই স্বঘোষিত গোরক্ষক বা স্বঘোষিত নীতি পুলিশদের ধমক দেন নি। বা
সেইসব কুখ্যাত সংগঠন নিষিদ্ধ করেন নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজস্থানে
গণপিটুনি বিরোধী বিল নিয়ে আসতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে রাজ্যটির
কংগ্রেস সরকারকে । অভিযোগ, বিজেপি বিধায়করাই তার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। ।
গত শুক্রবার ৩০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গণপিটুনি বিরোধী বিল পাশ করিয়ে
দৃষ্টান্ত রাখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু এখানেও সেই বিজেপি
বিধায়কদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলছে রাজ্যের শাসক দল। সব দল বিলকে
স্বাগত জানালেও, বিজেপি বিধায়করা সায় দেয় নি। এই বিল যাতে আইনে পরিণত না
করা যায়, তার জন্যে বিজেপি উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বিজেপির
এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, তারা গণপ্রহারের বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজ্য সরকার যে
পদ্ধতিতে বিল এনেছে, তা ঠিক নয়।
এই
বিল নিয়ে উচ্ছ্বসিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এই বিলকে ‘বিধবা বিবাহ
প্রচলন’এর মতো দৃষ্টান্তকারী আইনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন, ‘দেশ
যখনই সংকটজনক অবস্থায় থেকেছে, তখনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বাংলা।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মেনেই আমাদের সরকার এই বিল পাশ করেছে।’
কিন্তু
মমতা ব্যানার্জির পুলিশ কি এই বিলে খুশি? কারণ, তাদের হেফাজতেও বহু
মানুষের মৃত্যু হয়। এবং তাদের দেওয়া ধারায় বহু অভিযুক্ত খালাশ পায় বা লঘু
শাস্তি পায়। এই প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, আবদুল খাবিরের মরদেহ সরিয়ে নিয়ে
যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের অতি তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। যা স্থানীয় মানুষের
কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।
এখন
দরকার কী ঘটেছিল, কে কে জড়িত, তার সঠিক তদন্তের। ডা এ কে ঘটকের গ্রেফতার
দরকার। আর চাই নিরপেক্ষ বিচার। এবং ডাক্তার ও অন্য অভিযুক্তদের কাছ থেকে
ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অর্থ আদায় করে আকলিমা বিবির হাতে তুলে দেওয়া। তিন
নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে বুভুক্ষু দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
রাজ্যে
গণপিটুনি বিরোধী বিল পাশ হলো। এতে রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা প্রমাণিত হয়।
দোষিদের উপযুক্ত শাস্তি এবং মৃতের পরিবারের ভরনপোষণের সুব্যবস্থা হলে, তবেই
সেই সদিচ্ছা স্বার্থক হবে। রাজ্যবাসী সেই দিনের অপেক্ষায় রইলো।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours