কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:


ভূস্বর্গ কাশ্মীর।
গোটাটাই পাক গা-জোয়ারির অতীত। আর ধৈর্যের পরীক্ষা ভারতের। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের শ্যেনদৃষ্টি জম্মু কাশ্মীর উপত্যকার দিকে।
সেদিন কিন্তু আচমকাই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করলে, অখন্ড জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ উপত্যকার গোটাটাই থাকতো ভারতের দখলে। ঠিক যেমনটা শর্ত হয়েছিল জম্মু কাশ্মীরের শেষ রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা তখনকার মতো স্বস্তি এনে দিলেও, তা কিন্তু আজ পর্যন্ত মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়ে গিয়েছে দিল্লির।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার খেসারত দিতেই কাশ্মীরের একাংশ আজও পাকিস্তানের দখলে। পাক অধিকৃত কাশ্মীর। সীমান্তপারের ওই কাশ্মীরের আয়তন অঙ্কের হিসেবে, জম্মু কাশ্মীর উপত্যকার একশো ভাগের পঁয়ত্রিশ ভাগ। যা সরাসরি ছিনতাই করে নিয়েছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর। আমাদের ভাষায় পাক অধিকৃত কাশ্মীর। সংক্ষেপে পিওকে, পাক অকুপায়েড কাশ্মীর। লম্বা, চওড়ায় মিলিয়ে যার আয়তন তেরো হাজার দুশো সাতানব্বই বর্গ কিলোমিটার। রাজধানী মুজফ্ফরাবাদ।
এই অংশের মধ্যেই আছে, গিলগিট বালতিস্থান। বালতিস্থানের এই এলাকা আসলে পশ্চিম লাদাখের অংশ। এই গোটা ভূখণ্ডকেই ১৯৪৭ সালে ছিনতাই করেছিল পাকিস্তান। তারপরেও জম্মু কাশ্মীরের থেকে নজর সরেনি ইসলামাবাদের।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজন রেখা টানা হলো অখন্ড ভারতের বুকে। স্বাধীন ভারত হাঁটলো ধর্মনিরপক্ষেতার রাস্তায়। আর খন্ডিত ভারতের অন্য অংশের পরিচয় হলো মুসলিম রাষ্ট্র, পাকিস্তান। হিন্দু শরণার্থীর ভিড় আশ্রয়ের আশায় ছুটে এলো ভারতে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ঠাঁই হলো হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বুদ্ধ, জৈন, ক্রিশ্চান সবার।
ওদিকে তখন অশান্ত হয়ে উঠেছে কাশ্মীর। প্রক্সি ওয়ারের ছক কষে ফেলেছে পাকিস্তান।

জম্মু কাশ্মীরের রাজা হরি সিং হিন্দু। কিন্তু প্রজার এক বিশাল অংশই মুসলিম। জম্মু কাশ্মীরের আবেগের কথা ভেবে রাজা হরি সিং দোলাচলে ভুগছিলেন। ভারত নাকি পাকিস্তান। কোনদিকে হাত বাড়াবেন তিনি? তবে তাঁর নিজের ইচ্ছা ছিল, স্বাধীন থাকার। ওদিকে চাপ বাড়ছিলো। একদিন আশঙ্কা সত্যি হলো। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর। পাকিস্তানের পাস্তুন উপজাতির জঙ্গিরা ঢুকে পড়লো উপত্যকায়। দেখতে দেখতে তারা পৌঁছে গেল রাজধানী শহর শ্রীনগরে। পেছন থেকে গোটা ঘটনার কলকাঠি নাড়ছিলো পাকিস্তান। প্রমাদ গুনলেন ডোগরা বংশের শেষ রাজা হরি সিং। উপায়ান্তর না দেখে, ভারতের কাছে সরাসরি সামরিক মদতের আর্জি জানালেন রাজা। ভারত কাশ্মীর সংযুক্তিকরণের শর্ত মেনে, ভারতীয় সেনা পৌঁছে গেল উপত্যকায়।

১৯৪৭-৪৮। শুরু হলো প্রথম ভারত পাক যুদ্ধ। ভারতীয় জওয়ানের সামনে পড়ে পিছু হটতে লাগলো পাকজঙ্গীরা। কিন্তু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চাইলেন আপাত শান্তি। তারজন্য বড় মূল্য চোকাতেও রাজি ছিলেন তিনি।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বারস্থ হলেন নেহরু। অগাস্টের তেরো তারিখ। এক রেসোলিউশনে রাষ্ট্রসঙ্ঘ নির্দেশ দিলো, কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সরে যাক ভারত, পাক সেনা। তারপর কাশ্মীরবাসীরাই ঠিক করুক, তাদের ভাগ্য। বেছে নিক তারা কার সঙ্গে থাকতে চায়, ভারত নাকি পাকিস্তান। শোনা যায় ভারতের তৎকালীন শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ইচ্ছাও তাই ছিল। তাহলে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে নেহরুর ভারত জম্মু কাশ্মীর সংযুক্তিকরণ চুক্তির শর্ত কী হলো? এর উত্তর দিতে পারবেন রাজনীতিবিদরাই।
তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের রেসোলিউশনকেও পাত্তা দেয়নি পাকিস্তান। কাশ্মীরের একাংশ দখল করেই তারা বসে থাকলো। বরং আরও এক পা এগিয়ে, পাক সরকার একাংশ কাশ্মীরবাসীর সমর্থনে সওয়াল করে বসলো, ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের বৈধতা নিয়ে। তবে ওই গণভোট শেষ পর্যন্ত হয়নি।

নেহরুর ভরসা ছিলেন উপত্যকার জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লা। অক্টোবরের তিরিশ তারিখ। ভারতীয় সেনার দখলমুক্ত করা উপত্যকায় জরুরিভিত্তিতে গড়া হলো জম্মু কাশ্মীর সরকার।  প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ আবদুল্লা। রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণ হলো নেহরু, আবদুল্লার। কিন্তু ভারতের হাতে রইলো না অখন্ড জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ।
পরের বছর, ১৯৪৮ সালে জানুয়ারির এক তারিখে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলো ভারত পাকের। উপত্যকার এক বিশাল অংশ থেকে গেলো পাকিস্তানের কবজায়। ইতিহাসবিদদের মত, সমস্যার বিজ পোঁতা হয়ে গেছিলো সেদিনই।

১৯৪৮ সালে সিমলা চুক্তির সময় বিভক্ত কাশ্মীরের তৎকালীন অবস্থাতেই নির্ধারিত হলো লাইন অফ কন্ট্রোল। প্রতিবেশী দু দেশের মধ্যে চুক্তি হলো, অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলে দু'পক্ষই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে তা মিটিয়ে নেবে। দ্বিপাক্ষিক এই কথাবার্তায় তৃতীয় পক্ষের কোনও জায়গা থাকলো না। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ রেখা যে বাস্তবে কোনও কাজে আসেনি, তা বারেবারে স্পষ্ট হয়েছে পরবর্তী সময়ে। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় আতঙ্ক ছড়ানোর যে ছক কষেছিল পাকিস্তান, তার পুনরাবৃত্তি দেখা গেলো
১৯৬৫ সালেও। ফের পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারতের সঙ্গে। এবার হলো তাসখন্দ চুক্তি। ভারত আর পাকিস্তানের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী, আয়ুব খান এই চুক্তি করলেন। সেপ্টেম্বরে ফের ঘোষণা হলো যুদ্ধবিরতির।
বারবার তিনবার। সাল ১৯৭১। পাকিস্তানের সঙ্গে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো ভারত। দেশের পশ্চিমাংশে আঘাত হানলে পাক বায়ুসেনা। ডিসেম্বর তিন তারিখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো ভারত। অবরোধ করলো পাকিস্তানের বন্দরশহর করাচী। দু সপ্তাহের মধ্যে সরাসরি ঢাকায় পা রাখল ভারতীয় সেনা। আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তান। ফের সেই অস্ত্র সংবরণ। যুদ্ধবিরতি।
দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আরও একবার আলোচনার টেবিলে বসলেন, দু'দেশের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি, জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১৯৮০ সালের হলো সিমলা চুক্তি।

ইন্দিরা জমানা। ১৯৮০ সালের শেষদিক থেকেই উপত্যকার ছবিটা যেন বদলে যেতে থাকলো। পাকিস্তানের রং ক্রমেই চেপে বসতে লাগলো কাশ্মীর জুড়ে। প্রয়াত রাজীব গাঁধির সময় তা ভয়াবহ রূপ নিলো। ঘোরালো হয়ে উঠলো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সীমান্তপারের পাকিস্তান থেকে ব্যাপক গুলিগোলা ছুটে আসতে লাগলো ভারতের দিকে। জবাব দিলো ভারত। প্রয়াত বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং কড়া হাতে সন্ত্রাস দমন করার চেষ্টা চালালেন। ওদিকে তলেতলে জঙ্গিদের সামনে রেখে, পাক সেনারা ঘাঁটি তৈরি করে ফেলার চেষ্টা  করলো কার্গিলে। সাল ১৯৯৯। ফের সম্মুখসমর পাক ভারতের।

খাতায় কলমে যুদ্ধ শেষ হলেও জম্মু কাশ্মীর উপত্যকায় ধারাবাহিক ভাবে সন্ত্রাস চালিয়েছে পাকিস্তানি মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। যার জবাবি হামলায় সর্বশেষ, চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এবার কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা চায় ভারত। আর কোনও শীতযুদ্ধ নয়। পাকিস্তানের দখলদারি সরিয়ে ফেরত পেতে চায় উপত্যকার গোটাটাই। দেশের উপ- রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নায়ডু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সাফ কথায় জানিয়ে দিয়েছেন, এবার জম্মু কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আর একটিও কথা নয়। কথা যদি বলতেই হয়, তবে তা হবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours