জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা: 

দেশের সবথেকে শিক্ষীত, ত্যাগী একেবারে সাধাসিধে ভালো মানুষদের সমাবেশ হলেও, কেন যে ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলন, একটু হোচট খেলেই সন্তুলন হারিয়ে ফেলছে এই প্রশ্নটা উঠেছে বার বার। 
---- যতদুর স্মরনে আছে, কমরেড বি টি আরে এর দেওয়া শেষ ইন্টারভিউতে, প্রশ্নটা তুলেছিলেন  ভারতের আন্তর্জাতীক খ্যাতি সম্পন্ন ইতিহাসবিদ ডঃ বিপন চন্ত্র পাল। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, প্রনব মুখার্জীও এই প্রশ্নেই একবার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। 
এই সুত্রেই লেখকের মনে, শিরোনামায় উল্লেখিত প্রশ্নটা উঠেছিলো। এটা খুজতে খুজতেই মনে এসেছে হয়তো বা, মেহনতিদের প্রতিনিধী হিসেবে,
'রাজশক্তি' হিসেবে ভাবার মধ্যেও কিছু গন্ডোগোল কিংবা অসুবিধার কারন হচ্ছে। 
বিরোধী হিসেবে, ব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচনে, যা করার হয়তো করছি, কিন্তু নিজেদের 'রাজশক্তি'  হিসেবে নির্মানের জন্য, যা যা করার সেখানেই বুঝি সব অনিহা। 

এই সুত্রেই বলে রাখি, বিষয়টি  কমরেড জ্যোতি বসুর প্রধান মন্ত্রী, হওয়া কিংবা  না হওয়ার প্রশ্নের সাথে কোন মতেই যুক্ত নয়। সেদিন , যদিও জীবন রায়ের একটা  মত ছিলো এবং সেই মত যথা নিয়মে লিপিবদ্ধও করা হয়েছিলো, তবু  বলবো,
----- ওটা সাম্যের প্রতি দায়ীত্বহীনতা বলে দেখিয়ে , যে সব সংবাদ মাধ্যম বিশ্বকে তোলপাড় করতে চেয়েছেন , তারা অসৎ  উদ্যেশ্যে বিষয়টি উঠিয়ে এনে , সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রিকতাকে এবং আন্তর্জাতীকতাকে  ভেতর থেকে ভেংগে দিতে নিজেদের এক আন্তর্জাতীক  স্বরযন্ত্রের শিকার করেছিলেন। অনেকে সংবাদ মাধ্যম এই স্বরযন্ত্রের জাল বেছানোর কাজে অংশ নিয়েছেন। আমরা যারা সাম্যবাদী হিসেবে দাবী করি, কিন্তু ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনের সর্বাত্মক একতার ধারা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে আনতে, শ্রমিক আন্দোলনকে শ্রেনীর পর্য্যায় তুলে আনাটা যে ফলিত বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ধাপ 
----- সে কথাটা ভূলে গিয়ে, আমরাও এই স্বরযন্ত্রে পা' বাড়িয়েছি। ভূলেই গিয়েছিলাম, কোন সাম্যবাদী দলে,  কেন্দ্রিকতা এবং আন্তর্জাতীকতা চলে গেলেও,  অন্যদের থেকে পৃথক সৎ এবং ত্যাগি, দল হিসেবে টিকে গেলেও,  পরিস্থিতি শ্রমিকদের সাথে সাথে কৃষক মহিলা সমেত দুর্বল সম্প্রদায় বর্ণগূলিকে চির-দাসত্বে ঠেলবে।  

এমনটি ঘটবে একটা কারনেই - 
যে মুহূর্তে 'কেন্দ্রিকতা এবং আন্তর্জাতীকতার পবিত্রতা হারিয়ে ফেলবে, সেই মুহুর্তে সে শ্রমিকদের একতাকে সর্বাত্মক করা কিংবা সার্বনীনতার গনতন্ত্রের নেতৃত্বদায়ী ভূমিকাটাই হারিয়ে ফেলবে। 
এই কথার সুত্র ধরে, সাধারনভাবে এখন যে গনতন্ত্রের অভিমুখে আমরা দাড়ীয়ে আছি, ধ্বষে যাওয়া রেঁনেশায় যাকে লেনিন  'শুয়োরের খোয়ার' ,বলে মেনেছেন -  প্রশ্ন উঠবে , দল কেন্দ্রিকতা কিংবা আন্তর্জাতীকতা কেন হারাবে?  সেখানে  উত্তরের জন্যেও আমাদের বার বার লেনিনেরই স্মরনাপন্ন  হতে হবে
------উনি বার বার বুঝিয়েছেন,কেন্দ্রিকতার মূল দায়  যেখানে দলে এবং দলের বাইরে শ্রমিক সহ সব রকমের মেহনতিদের সংরক্ষন দেওয়া এবং এই সংরক্ষনকে দীর্ঘকালিন দায়বদ্ধতার দিকে ঠেলে নেওয়ার প্রশ্নেই লেনিনবাদ শ্রমিক আন্দোলনে গনতনন্ত্র এবং সদস্যপদের সার্বজনীনতাকেই কেন্দ্রিকতার কাছে দায়বদ্ধ রেখেছে।

-----  এই সুত্রেই বলা হয়েছে, দলে  গনতান্ত্রিক সত্বা সমুহের সাধারন প্রতিনিধীত্ব নিশ্চিত থাকবে, কিন্তু শ্রমিক বিবর্জীত কেন্দ্রিকতা, কেন্দ্রকে বিপরীত বর্গের হাতে ঠেলে নিয়ে যাবেই। সে ক্ষেত্রে এদেশে কেন্দ্রিকতার আধার যদি ব্রাহ্মন্যবাদের দিতে চলতে শুরু করে স্বতসিদ্ধভাবে, আন্তর্জাতীকতার ভাবাদর্শগত অভিমুখ  'আমেরিকান মিলিটারি তন্ত্রের'  ঘর' থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকবে। 

জীবন রায়ের মতো যারা সম্ব্রান্ততার ছাপ নিয়ে, দলের সিলমোহরে শ্রমিক আন্দোলনের নেতা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তারা চুড়ান্ত নিশ্চিতির সাথে ঘোষনা করেছেন,
------ যারাই নিজে শপথ নিয়ে ঘোষনা করেছেন, তারা সবাই নাকি এই 'শপথের জোরেই' নাকি শ্রমিক হয়ে গেছেন। কি বলা যাবে কিংবা কী বোঝানা যাবে। উচ্চবর্ণজাতরা গায়ের রক্ত- ঘাম ফেলার সাথে সাথে তত্ববোধ এবং  সাধারন শ্রমিকদের শ্রেনী রাজনীতির পর্য্যায়ে উঠিয়ে আনার সংগ্রামের নিরন্তরতায় (যাকে লেনিন  নিরবিচ্ছিন্ন বিপ্লব বলে সম্বোধন করেছেন,) নিজেকে শ্রেনীগত উত্তোরন ঘটানোর সুযোগ পান নাই, এমন কেউ যদি নিজেকে- শ্রেফ শপথের কেরামতিতে নিজেকে - 'বর্ণচ্যুত শ্রমিক প্রতিনিধী' হেসেবে  দাবী করেন, তিনি প্রতারক বই অন্য কিছু হতে পারেন না।  
ভারতবর্ষীয় নামক দেশটিতে বিগত পাচ হাজার বছর ধরে, ভেতর থেকে উঠে আসা কোন বিপ্লব যেহেতু, সমাজের তালানীতে জমা  হতে থাকা ইতিহাসের পুজরক্ত সাফাই এর কোন আয়োজন হয় নাই সেখানে, সেখানে ব্রাহ্মন্যবাদের উদয় যে  ঘটেছেইলো এই সব পুজরক্তের মধ্য থেকেই
---- এ বিষয়টা  তো যেকোন সাম্যবাদীকে বুঝতে হোত। শুধু বোঝা নয়, চিত্তের কোনায় কোনায় লড়াই চালিয়েই ব্রাহ্মন্যবাদের কু আচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হোত। নিজের ভেতরের সংগ্রাম কখনো কোন অভিমুখ পেতে পারবে না
----  যত সময়, বাইরের সংগ্রাম, মানুষের কাছ থেকে শেখা এবং নিজের পরিবর্তনের কারনে, পরিবারের রুপান্তর প্রকৃয়ায় নিজেকে যুক্ত করার আয়োজন এক অখন্ড নিরন্তরতার সাথে না চালানো হয়।
----- ইতিহাসগত কারনেই,  এদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন তো বটেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মুল শ্রোতের সামনের মাঝি-মল্লারদের অধিকাংশই যেহেতু, ব্রাহ্মন্য সমাজের সামনের দিকের লোকজনদের নিয়ন্ত্রনে, সেখানে
কারখানার বা খনিমুখের সরাসরি সাহায্য ব্যতিত, এদের শ্রেনীগত রুপান্তরন অসম্বব।
আমাদের কালে বলা হোত, যারা জেলে গিয়ে, কয়েদীদের হাতে পেটাই  খেয়েই, একজনের  কমিউনিষ্ট মুখীন রুপান্তরনের শুরুটা হয়। তাছারা, সেকালে পুলিশের এবং গুন্ডার পিটুনী খেয়ে, নিজের হাতে ভাষনের মঞ্চ নির্মান, কোন মাইক-টাইকের পরোয়া না করে চোংগা ফুকে মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে, গা থেকে ব্রাহ্মন্যবাদের পুজ-রক্ত নামাতে হোত। 
--- এবারে চুপি চুপি আবারো  বলি। সেই প্রধানমন্ত্রীত্বের বিষয়ে জীবন রায়ের একটা পৃথক মতামত ছিলো। নিশ্চিত করে বলতে পারি, দলের কেন্দ্র বিদ্বান এবং ত্যাগি কমরেডদের পাশাপাশি, কারখানার জীবন্ত অভিজ্ঞতা মিশে থাকতে পারতো
----- তবে, সিদ্ধান্তটা,  Yes এবং   No এর মাঝখানে অন্য  কোন একটা সিদ্ধান্তই হোত। কিন্তু যতটুকু বুঝেছিলাম, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য একটা হিসেব কাজ করেছে। যারা এটা বোঝেন নাই, যে সাম্যবাদীদের নেতৃত্বাধীন কোন সরকার একদিন টিকতে পারবে না

----- যদি সে সমান্তরালভাবে  জনসংযোগ এবং জন পরিচালনার প্রশ্নে সাম্যবাদী দলটি তত্ব এবং সাংঠনিকভাবে স্বয়ংভর না হতে পারে। এ রকম একটি সরকার চালাতে গিয়ে সব সময়, কিউবার কথা বিবেচনা না রাখলেও, 'চিলির' কথা স্মরনে রাখতেই হোত। সেখানে প্রকৃত প্রতিপক্ষ হিসেবে আমেরিকার মিলিটারী তন্ত্রকে মানতে হোত।  

কাজেই, রাজনীতিতে সাম্যবাদী কিংবা শ্রেনী হস্তক্ষেপের বিষয়টি যখনই আসবে তখনই
----- কেন যে এতো বিদ্বান, ত্যাগী ব্যক্তিত্ব থাকা সত্বেও কেন এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে- পরার প্রশ্নটি উঠবেই 
---- তখন দল এবং সংগঠনের কেন্দ্রিকতা এবং আন্তর্জাতীকতায় অপবিত্রতা নেমে আসার বিপদের বিষটি সামনে আসবেই । 

সেই সুত্র ধরেই যদি এমন প্রশ্ন ওঠে যেন, সাম্যবাদীরা 'বিরোধী' ভূমিকাতেই থাকতে ভালোবাসে, দায়ীত্ব নিতে পিছিয়ে যাওয়ার রোগে ভোগে তখন
--- তত্ব এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিপ্লবের লেনিনবাদী সুত্রগুলির একাত্মতার বিষয়গুলি সামনে আসবেই।
তখন মানতেই হবে, দলের কর্মসূচীর সাথে যদিওবা ভাবাদর্ষ এবং  দর্শনের  মধ্য সেতু নির্মানে ১০/১৫  ভাগ কর্মী সদস্য সেতু বন্ধনে সক্ষম হবে,
---- শ্রমিক গনতন্ত্রের আকাশচুম্বিতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন সদস্বপদের সার্বজনীনতা বা শ্রমিকদের সর্বাত্মক একতার সাথে দলের কেন্দ্রিকতার সেতুবন্ধন গটিয়ে
----- শ্রমিক আন্দোলনকে গনতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেমনি হিসেবে উপস্থিত করার কাজটিতে যদি ৫ ভাগ নেতা-কর্মী সফল কাম হতেন, তবে আজ ফ্যাসিবাদের ভাবনা ভারতকে ভাবতে হোত না। অথচ, একেই বলে ফলিত বিজ্ঞান । 

কাজেই পরের কথাটা এখান থেকেই শুরু করতে হবেঃ
----- দর্শনের দারিদ্রতাকে দূর না করে, ভারতে ইতিহাসের মুক্তি নাই। বোধ হয়, এই বিন্দুতেই, জীবন রায়ের সাথে আমেরিকার নব্য দর্শনধারীদের কিঞ্চিৎ মিল খুজে পাওয়া যাবে। (ক্রমশ)
 

 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours