শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

করমচাঁদ গান্ধী সুইপার সম্প্রদায়ের নাম পাল্টে হরিজন সম্প্রদায় করেন। অনেকটা "যার কেউ নাই তার আল্লাহ্ আছে, ভগবান আছে" এই রকম একটি বিষয়। কেন না, সুইপার বা হরিজনদের পক্ষে কথা বলার আসলেই কেউ নেই। সনাতন ধর্মে হরি পবিত্র শব্দ। গান্ধী জী, অচ্ছুৎ অস্পৃশ্য সুইপার  সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে, তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হরিজন শব্দটি ব্যাবহার শুরু করেন। কেন না, এ উপমহাদেশে ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি। কিন্তু ঐ যে চোরে না শুনে ধর্মের কথা। মেথর বা সুইপারদের নামের আগে  'পবিত্র হরি ' শব্দ প্রয়োগনকরেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।  ভারতে তো নয়ই বাংলাদেশেও না। বাংলাদেশে হরি, ও হরিজন কখনোই পবিত্র শব্দ ছিলো না। যদিও ভীমরাও আম্বেদকার  গান্ধীজির এই হরিজন আন্দোলনকে "আইওয়াশ" জাতীয় কিছু  মনে করতেন। আম্বেদকারের নিকট গান্ধীজির এ দেয়া হরিজন নামটি তিনি ভালো চোখে দেখেননি কখনো। কেননা, তিনি মনে করেননি সুইপারদের নাম বদলে হরিজন সম্প্রদায় রাখলেই তাদদের মর্যদা বেড়ে যাবে বা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
 ভীমরাও  আম্বেদকার রামজী নিজেও ছিলেন সুইপার/ দলিত / বা হরিজন সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি। ভারতের দলিতরা তাকে "বাবা সাহেব" বলে সম্বোধন করে থাকে।

ভীমরাও  রামজী আম্বেদকার আমেরিকা থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহন করেন। ভারতের সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ভারতীয় সংবিধান ও রাজনীতির ইতিহাস লিখলে তার নামও চলে আসে। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো, তার নামে মরনোত্তর  "ভারত রত্ন' পুরস্কার পেতে প্রায় তিন যুগ লেগে যায়।

আমাদের এলাকায় সুইপার কোলনী রয়েছে।  এক সময় সুইপার কলোনীর সভাপতি হতো যারা সুইপার নয়। একবার দেখিছি সরিষাবাড়ি স্টেশনের (জামালপুর) সুইপার কলোনি থেকে নারী পুরুষ কিশোর কিশোরীরা মৌমাছির মত ছুটে আসছে। আর আমার বন্ধুর বাবার বেকারিতে হামলা করেছে। আমরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই বেকারী তছনছ করা সারা। আর কাকে যেন খুজছে পেটানোর জন্য। যদিও বেকারিতে উপস্থিত থাকা কয়েকজনকে পিটিয়েছে। আর যারা,আশে পাশে উপস্থিত রয়েছেন তারা হতবিহ্বল হয়ে গেছেন ঘটনা দেখে। পরে তাদের শান্ত করার পর জানা গেলো সুইপার কলোনীর এক মেয়ে স্থানীয় গার্লস স্কুলের ছাত্রী। বেকারির কোন কর্মচারি সেই সুইপার কোলনীর মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছিলো। আগেও তাকে বেশ কয়েকবার  বিরক্ত করেছিলো। তাই এবার তারা সরাসরি আক্রমনে! ( শিমলা বাজার, আমতলা মোড়ে  ১৯৯২/৯৩  সালে ঘটনাটি ঘটে) শিমলা বাজারে সুইপার কলোনির আরো কয়েকজন মেয়ে গার্লস স্কুলে পড়তো। তারা অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে দলবদ্ধ হয়েই স্কুলে যেতো,আসতো। তারা পাশাপাশি বেঞ্চেই বসতো। যা এক সময় হরিজন সম্প্রদায় কল্পনাও করতে পারতো না।
 
শিমালা বাজারে একজন হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিলো ধরে নেই তার নাম ধরনেই পুর্নীমা।  সে দোকানের সামনে ঝাড়ু দিতো।  বাজারের পথ ঘাটও পরিস্কার করতো। সে খুব সুন্দরী ছিলো। তবে খাটো। গরীবের মেয়ে, বউ সুন্দরী হলে যায় হয়! তাদের,পেছনে লেগে যায়, একশ্রেনী। সুইপার বা হরিজন হয়েছে তো কি হয়েছে? নারী তো!  তার শরীর আছে আছে যৌবন, সৌন্দর্যও। বাজারের অনেকেই তাকে অর্থের লোভ দেখিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে নামায়। এক সময় তার বয়স বাড়ে এবং তার সৌন্দর্যের হানি ঘটে। আমি তার বয়সে বেশ  ছোট ছিলাম। আমি যখন বুঝতে শিখেছি  তখন দেখলাম। পুর্নিমা বেশ কয়েকজনের রক্ষিতা। কি হিন্দু কি মুসলমান সে রাতের বেলায় হতো অনেকের স্বপ্নের রানী। যারা পুর্নীমাকে দিনের বেলায় গ্লাসে জল খেতে দিতো না। কাপে চা খেতে দিতো না। ছুঁয়ে দেখা তো দুরের কথা, কথাও বলতো না। তারাই পুর্নীমার শরীর ছোঁয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠতো। যারা, দিনে  মুখোমুখি হতে ঘৃনা করতো তারা  রাতে পুর্নিমার কোথায় কোথায় মুখ ঠেকায়নি তাই গবেষণার বিষয়।

টিনের চালা ঘরে ভিসিআরে  হিন্দি মুভি দেখতে গিয়ে কিছু হরিজন সম্প্রদায়ের লোকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। সেই সুবাদে আমি দেশের কয়েকটি সুইপার কলোনিতে যাই। আমি বেশ কয়েকবার হরিজনদের ঘরে "অতিথি ' হিসেবে গিয়েছি। তারা,আরো বিস্মিত হয়েছে আমি মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং মদও পান করি না। সিগারেট খাই না।  উল্লেখ্য আমি তখনও মদ পানে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। আমি তাদের কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তাদের আপ্যায়ন ভুলবার নয়। আমার জন্য মুসলিম পরিবার থেকে  রান্না করে এনে খাওয়াতো। যারা রান্না করে দিতো তারা আমাকে বলতো, ছি! ছি!  সুইপারদের কলোনি কি বেড়ানোর জায়গা? আমি হরিজনদের রান্নাও খেতাম। তারা খুশি হতো। আমি শুয়োরের মাংস খেতে চাইলে বাধা দিতো। খাসি মুরগি খেতে বলতো।

আমার দৃষ্টিতে হরিজনেরা দাসদের মতই জীবন যাপন করে। তাদের চিন্তা ভাবনার জগৎ খুবই ছোট। পৃথিবী তো দুর ; দেশের রাজানীতি অর্থনীতি নিয়ে তাদের কোন ভাবনাই নেই। শিক্ষা ছাড়া যে মানুষের চিন্তার পরিধি বাড়ে না। তা, হরিজনদের সাথে কথা বললেই বুঝা যায়। 
   যদিও  বাংলাদেশে এরা ভোটার। আমি তাদের কখনো জমি কিনতে দেখিনি। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক দেখেছি ১৯৯২/ ৯৩ সালেও। তখন লক্ষ লক্ষ টাকা মানে মফস্বলে।অনেক টাকা। হরিজনদের কোন মেয়ে  কখনো কোন মুসলিম সম্প্রদায় অথবা কোন সনাতনধর্মাবলম্বী  বিয়ে করে ঘরে তুলেছে বলে আমি দেখিনি। এখনো আমার কাছে এমন  তথ্য নেই যে কোন হরিজন কন্যা অন্য কোন সম্প্রদায়ের বউ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সুইপার কলোনিতে এক ধরনের জ্বর দেখা দিতো "রিউমেটিক ফিভার"।  মেডিসিন  বিশেষজ্ঞ ডক্টর লেলিন চৌধুরী  ২০১৫ তে একবার বলেছিলেন, সুইপার কলোনীতে স্যাঁত স্যাঁতে  ঘিঞ্জি পরিবেশ ও সুর্যের আলো কম থাকায় যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
 
ভারতের জুম্মু কাশ্মীর একবার দলিতরা ধর্মঘট করেছিলো। শেখ আব্দুল্লাহ তখন কাশ্মীরের শাসক। বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাল্মীকি (দলিত) কে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনুরোধ করে নিয়ে আসেন। দশকের পর দশক চলে গেলও তাদের জুম্মু কাশ্মীরেরব নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। তাদের প্রজন্ম শিক্ষিত হলেও তাদের কোন চাকুরি দেয়া হয় না৷ কাশ্মীরে সাংবিধানিক ভাবে (?) লেখা আছে তারা যত শিক্ষিত হোক তাদের মেথরগিরিরই করতে হবে!  
ভারতে সুইপারদের দলিতও বলা হয়ে থাকে।  তারা জাতপাতের নামে নির্যাতিত হলেও, তাদের রয়েছে রাজনৈতিক দল। শিক্ষা ও সুযোগ পেলে  একজন দলিত, একজন হরিজন কোথায়,পৌঁছাতে পারে ভি আর আম্বেদকার তার উজ্জল ঐতিহাসিক উদাহারন।  ভীমরাও  রামজি আম্বেদকর কেবল দলিত নয়, যে কোন পশ্চাৎপদ সমাজের আদর্শ হতে পারে। শিক্ষা যে একটি শক্তি তারও উৎকৃষ্ট উদাহারন তিনি। 

পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। ধনী ও দরিদ্র। দরিদ্ররা নিষ্পেষিত নিপিড়ীত শোষিত বঞ্চিত। আর এই মেথর, সুইপার বা হরিজন যাই বলি না কেন তারা আরো বেশি শোষিত নিষ্পেষিত নিপিড়ীত শোষিত বঞ্চিত। তাদের কোন সামাজিক অধিকারই নেই। আজ যে শিশুটি সুইপার কোলনিতে জন্ম নিলো আর যে বাইরে। তাদের এ জন্ম নেয়ার কারনে  একজন মুক্ত মানুষ আরেক জন অচ্ছুত্য হয়ে গেলো! এ নিয়ম ভাঙ্গতে হবে। কেউ আসমান থেকে এসে এ নিয়ম পরিবর্তন করে দিয়ে যাবে না। মানুষের সৃষ্ট এ নিয়ম মানুষকেই পরিবর্তন করতে হবে।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours