মৌসুমী মন্ডল, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

শ্রাবণ মাসের পরেই আসে ভাদ্রমাস। গ্রাম বাংলার মানুষেরা শ্রাবণ মাসের সাথে ভাদ্রমাসের এক নাড়ির টান লক্ষ্য করে থাকে। শ্রাবণ মাসকে দেবাদিদেব মহাদেবের মাস ধরা হলে, ভাদ্র মাসকে ধরা হয় মনসাদেবীর মাস। শোনা যায় শ্রাবণ মাসে শ্রাবণসন্ন্যাসীদের বাঁকের জলে যখন গ্রাম বাংলার নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল উপচে যায় তখন সাপেদের গর্তে জল ঢুকে গেলে তারা আশ্রয় নিতে শুরু করে গৃহস্থের বাড়িতে। কখনও তাদের দেখা যেত কুন্ডলী পাকিয়ে উনুনেতে বিশ্রামরত অবস্থায়। আবার কখনও গৃহস্থের খড়ের চালে, আবার কখনও ধানের গোলায় দেখা মিলত তাদের। মা মনসার জীবন্ত রূপ হিসাবে মানা হত এই জীবকে। সরস্বতী, লক্ষ্মীর মতো পশ্চিম বাংলার বুকে মনসার আদরও কম নয়। বিশ্বকর্মা পুজোর আগেরদিন অমাবস্যার অন্ধকারে চাঁদ যখন নিদ্রা যায় ঠিক তখনই সেই আঁধারে বাড়ির সবাইকে একত্রিত করে কুটনো কাটা থেকে শুরু করে রান্ন-বান্না চলে। ডাল চচ্চড়ি, আলু ভাজা, ইলিশের পদ, পোনামাছ ভাজা, কচুর ঘন্ট, কুমড়োর ঘন্ট, ছাঁই, পায়েস ইত্যাদি পদ হয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, রান্না পুজোয় বসার আগে উনুন সাজানো হত। উনুনের চারিপাশে চালের গুঁড়ির আলপনা দেওয়া
হত। থাকত গাছ কৌট, ফণি মনসা গাছের ডাল ও থাকত কাশফুল। উনুনের গায়ে তেল সিঁদুরে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে বাড়ির মা কাকিমা-রা শঙ্খধ্বনির সাথে রান্না শুরু করতেন। সারারাত ধরে রান্না হত। গোটা গ্রাম সেদিন জাগবে। আস্তে আস্তে অমাবস্যার আঁধারের বুক বেয়ে যখন হাল্কা ভোরের আলো চুঁয়ে পড়ছে তখন সব রান্না শেষ। তবে সব শেষে মাটির হাঁড়িতে ভাত বসত। ভাত হয়ে গেলে সেই ভাতে জল ঢালা হত। হ্যারিকেনের আলো নিভিয়ে শঙ্খধ্বনি দিয়ে রান্না পর্ব যে শেষ হল তার জানান দেওয়া হত। বাড়ির মা-মাসি-কাকিমা-রা স্নান সেরে আকাশ পরিস্কার হওয়ার আগেই মনসা মায়ের কাছে ভোগ নিবেদন করে থাকতেন। মা মনসা যেহেতু সধবা দেবী তাই এইদিন তাঁর ভোগে আমিষজাতীয় পদ রাখা হত। ইলিশের পদ থেকে শুরু করে পুঁইশাক চিংড়ি, বিভিন্ন মাছ ভাজা ইত্যাদি। যেহেতু নাগ-নাগিনীরা জলা জঙ্গলে বেশী ঘুরে বেড়ান তাই কচু, শাক, শাঁপলা ডাটার ডাল ইত্যাদি পদ রাঁধা হয়। রান্নার পরের দিন থাকে পান্না। অর্থ্যাৎ আগের দিন রাতে যা রান্না হল পরেরদিন তা পাড়া- প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর পালা। এইদিন আর উনুন জ্বলবে না। তাই এটিকে ‘অরন্ধন’ও বলা হয়ে থাকে। আজও দিদিমা-দের কাছে রান্নাপুজোর গল্প শুনতে বসলে তাঁরা সর্বপ্রথম মাথায় ঘোমটা দিয়ে কপালে হাত তুলে নমস্কার করে সেই রাত্রের গল্প শুরু করেন, যে রাত্রে বাড়ির পিছন দিয়ে হিসহিস শব্দে স্বয়ং মা মনসা তাঁর জীবন্ত রূপ ধরে বেয়ে গিয়েছিলেন। আজও দেখা যাবে রান্নাপুজোর দিনে মা মনসাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোথাও মা মনসার মূর্তিকে, কোথাও পঞ্চসর্পের ফণার মূর্তিকে পুজো করা হয়। এইভাবে বাঙালির বারোমাসে তেরোপার্বণের মধ্যে রান্নাপুজো এক অন্যতম পার্বণ হিসাবে পশ্চিমবাংলার বুকে বেঁচে আছে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours