গার্গী দাস, সাংবাদিক, কলকাতা:
পুজো পার্বন উৎসব মানেই কদমার কদর। আর কদমা বলতেই মানকরের কথা স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে বাঙালীর হৃদয়ে। অথচ শতাধিক বছরের এই সুস্বাদু স্থানীয় মিষ্টির রমরমা বাজারের জৌলুস আজ অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে যেতে বসেছে নানা কারণে। যদিও চলতি পুজো মরসুমকে ঘিরে কদমা ব্যাপারীরা ফের আশার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সুদিনের প্রত্যাশায়।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর মহকুমার মানকর আগাগোড়াই প্রসিদ্ধ সুস্বাদু ও উৎকৃষ্ট মানের কদমা তৈরির জন্য। প্রধানত বাঙালী সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে মানকরের কদমার চাহিদা তুঙ্গপর্স্পী। শতাধিক বছরের এই লোভনীয় শুকনো মিষ্টি তৈরি হয় মূলত চিনির সাহায্যে। ছানার জলের সঙ্গে প্রয়োজন মতো চিনিকে দীর্ঘক্ষণ উনুনে জাল দিয়ে ঘন সিরা প্রস্তুত করা হয়। এরপর সেই সিরাকে বড় আকারের কাঠের পাটাতনে ঢেলে কিছুটা শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরমধ্যেই চলতে থাকে দুই হাত দিয়ে গরম সিরার উপর বিরামহীন ঘষাঘষি। আর তাতেই শুকনো সিরায় লাগতে থাকে সাদা রঙ। বিশেষ পদ্ধতির এই ঘষাঘষি যত উন্নত মানের হবে ততই ধবধবে সাদা হয়ে যাবে কদমার রঙ। আর এখানেই বিশেষত্ব মানকরের কদমার। এই পর্ব শেষ হতেই সেই সাদা জিনিষটিকে বেশ লম্বা আকারে কেটে নেওয়া হয়। তারপর তাকে চাহিদা অনুযায়ী লম্বাটে বা গোলাকৃতি কদমা বানানো হয়। আঙুল দিয়ে নক্সাও করা হয় তার উপর।
খুব ছোট মাপের এবং অনেকটা মার্বেল আকারের গোল কদমার বর্তমান বাজার দড় কেজি প্রতি আশি টাকা। পাঁচশো থেকে সাতশো গ্রাম ওজনের কদমা কিলো প্রতি পাওয়া যায় নব্বই টাকায়। একশো দশ টাকা কেজিও কদমা মিলবে মানকরে। যার ওজন প্রায় সাত কিলো পর্যন্ত। প্রধানত ফি-বছর পুজোর কিছুদিন আগে থেকে স্থানীয় কারিগরেরা কদমা বানানো শুরু করেন। এই প্রস্তুতি চলতে থাকে কালীপুজো পর্যন্ত।
অনেকে আবার বংশ পরম্পরায় কমদা তৈরি করে চলেছেন প্রতি বছর। যার কদর সমগ্র বঙ্গ সমাজে বহু যুগ জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে। বিশেষত বাঙালীদের নানান পুজোয়, বিয়েতে, উৎসবে ও একাধিক পার্বণে মানকরের কদমার আকর্ষণ একেবারে প্রথম সারিতে। এমনকি ভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী অধিকাংশ বাঙালীরাও মানকরের কদমার স্বাদ পেতে উৎসুক হয়ে থাকেন। বিদেশের প্রবাসী বাঙালীরাও বহু সময় মানকর আসেন শুধুমাত্র এখানকার বিখ্যাত কমদা সংগ্রহ করতে।
এহেন খ্যাতনামা কদমার বাজারে বিগত কয়েক বছর যাবৎ মন্দার ছোঁয়া লেগেছে। নিখুঁত কারিগরের অভাব, চিনির লাগাতার দাম বৃদ্ধি, চলতি প্রজন্মের কাছে ফাস্টফুডের অভাবনীয় চাহিদাই যে কদমার বাজারে পড়তি কারণ হয়ে উঠেছে তা এককথায় মেনে নিয়েছেন স্থানীয় মিষ্টি বিক্রেতারা। কদমা ব্যবসায়ী কাত্যায়নী রঙ্গরাজ বলেন, ‘আগে এখানে অনেক কদমার দোকান ছিল। বেশ কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে নানাবিধ কারণে। চিনি দাম বেড়ে গিয়েছে। কারিগড়ের অভাব। এখনকার যুব সম্প্রদায়ের আবার ফাস্টফুডে ঝোঁক। এর উপর আবার জাতীয় সড়কের অভিমুখ পালটে যাওয়ায় যাত্রীরা মানকরে ঢুকতে উৎসাহ দেখান না। দেখি এবার পুজোর মরসুম কেমন যায়? বিক্রি বেশি হলে লাভের মুখ দেখতে পাবো।’ অপর এক কদমা ব্যাপারী চন্দ্রকান্ত রক্ষিত বলেন, ‘মানকরের কদমার চাহিদা আজও অপরিবর্তিত। তবে সামগ্রিক বাজারে কিছুটা মন্দা আছে। যদিও আমার দোকানে কদমার বিক্রি যথেষ্ট ভাল। আশা করি এবারের পুজো মরশুমে বিক্রি খুবই হবে।’
Post A Comment:
0 comments so far,add yours