দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

কেন্দ্র সরকারের তরফে ডেউচা পাচামি কোল ব্লককে ছাড়পত্র দেওয়ার পর, অনেকেই স্বঘোষিত আনন্দ প্রকাশ করেছে। শিল্প হবে! গালি দিয়ে কথা বলতে যারা অভ্যস্ত। মানে যাদের পরের ভালো দেখলে চোখ টাটায়, তারা বলছে, প্রকৃতি লুঠ হবে। আদিবাসী জঙ্গল হারাবে। জঙ্গল উদোম গায়ে বলবে এসো, বৈধ অবৈধ ভাবে আমাকে ধর্ষণ করো!

তাই  একপক্ষ খুশি। কিন্তু আরেক পক্ষ সিঁদুরে মেঘ দেখছে। কিন্তু, প্রতিশ্রুতি মত কাজ হলে তো বলতে হয় (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়)- ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির/ অন্ধকারের থেকে আলোর দিকেই পাল্লা ভারী হচ্ছে।
কিন্তু নিন্দুকেরা বলছে (সেই কবি সুভাষের ভাষাতেই) -- 
"ডান দিকটাকে বাঁদিকে
আর বাঁ দিকটাকে ডানদিক করে আয়নায় এভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া---"
আমাদের আজ খুব পছন্দ।

সরকারের হাতে হয়তো কোন বিকল্প নেই! শিল্প নেই। তাই এই মড়া রাঢ় বাংলায় এই একমাত্র শিল্প হবে। তবে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুটি বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ১) উত্তোলনের পর কেমন কয়লা পাওয়া যাবে। ২) কতটা খরচ হবে। ৩) আদিবাসীদের পুনর্বাসন।

এসব কথা মাথায় রেখেই কেউ কেউ বলছেন----
আগে ন'মণ ঘি পুড়ুক। তারপর রাধা নাচার গল্প! পাঁচামি কোল ব্লক নিয়ে অনেকেই সন্দিহান! বিহার, পঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিল নাড়ু প্রথমে পশ্চিম বঙ্গের সাথে এই কয়লা উত্তোলনের শরিক হয়েও পিছিয়ে গেল কেন?

ধানবাদের ইণ্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনস থেকে বিশেষজ্ঞরা পাঁচামি কোল বলয় পরীক্ষা করে দেখে ২০০ ফুট পাথরের নীচে কয়লা। তাও খুব উন্নত মানের কিনা সন্দেহের। তাছাড়া এই কয়লা বলয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর ফলে উত্তোলনের সমস্যা হবে। ‌তাছাড়াও, কয়লা উত্তোলনের খরচ অনেক হবে। এই উত্তোলন লাভজনক হলে, কোলফিল্ড কি বসে থাকতো? হুমড়ি খেয়ে পড়তো। এই দিকটাও ভাবাচ্ছে মানুষকে!

এমনিতেই পাথরের দূষণে  আদিবাসীদের গড় আয়ু কমে গিয়েছে। তবুও কর্মসংস্থানের অভাবে, জঙ্গলের দাবি থেকে তারা একটু হলেও সরে এসেছিল। যেহেতু পুরোটাই আদিবাসীদের জায়গা, তাদের অংশীদার করে ভূসম্পদ নিত্য বৈধ অবৈধ ভাবে লুঠ হয় ওখানে। আদিবাসী শোষণ বন্ধ হয় নি। কারণ এই শোষণ চেয়েছে সভ্য সমাজ। এক শ্রেণীর মানুষ ধনী হয়েছে, কিন্তু মোটের উপর আদিবাসীরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে গেছে। এই শোষণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনকেও দ্বিমুখী করে, তার অভিমুখ বদলাতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছে কায়েমী স্বার্থ।

কিন্তু, আদিবাসীরা কিভাবে একটু হলেও পশ্চাৎপদ হলো?  এর উত্তর হিসেবে বলা যায়-- পাথর খাদান ও ক্রাশার, আদিবাসীদের কাছে ছিল অনোন্যপায় করুন পরিণতি। যা তারা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই কোল ব্লক, তার ভবিষ্যৎ যায় হোক,  তাদের উৎখাত করতে পারে, এই আশঙ্কা এখন তাদের পেয়ে বসেছে।

এব্যাপারে আদিবাসী গাঁওতার আহ্বায়ক সুনীল সোরেন বলেন, গোটা বিষয়টির আমরা নজর রাখছি। দুই সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাদের তো গ্রাউন্ডে কাজ করতে হবে। আমরা অবশ্যই দেখব, আদিবাসীদের স্বার্থ। তার ব্যাঘাত ঘটলে, প্রতিরোধ হবে। তবে এখনই কিছু বলছি না আমরা। 

বলে রাখা ভালো, একসময়, এই পাথর দূষণ, জঙ্গলের অধিকারে আদিবাসী গাঁওতার আদিবাসী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। 

এবার আসি, এই কোল ফিল্ড নিয়ে কি খাওয়ানো হচ্ছে!  দেশের  এই কয়লা খনিতে সরাসরি ১ লক্ষ বেকারের কর্ম সংস্থান হবে বলে দাবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো জন্য বিভিন্ন ভাবে কয়েক লক্ষ মানুষের পরোক্ষ ভাবে কর্মসংস্থান হবে ।  এর সঙ্গে  নতুন রাস্তা,সেতু,হাসপাতাল,স্কুল,কলেজ,বাজার তৈরী হবে।   জানা গেছে, এই পাঁচামী কোল ব্লক  ৩৪ টি আদিবাসী গ্রাম নিয়ে। ভাড়কাঁটা ও হিংলো পঞ্চায়েতের অধীনে।
 
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব বাড়বে। কিছু কর্ম সংস্থান হবে। ডেউচা পাচামি কয়লা খনির প্রস্তাবিত এলাকায় বর্তমানে জেলার এক মাত্র শিল্প এলাকায় কালো পাথরের ১৫০টি খানান ও প্রায় ৪৫০টি পাথর ভাঙ্গার মেশিন আছে। এই পাথর শিল্পাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার  মানুষ  কর্ম করেন। 

এবার আসা যাক জেলা প্রশাসনের সূত্রে।  জানা গেছে, বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ড  লিমিটেদের এই কয়লা প্রকল্পের  ডেউচা- পাচামী এলাকায় ৯.৭ বর্গ কিমি এবং দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিঙ্গা এলাকার ২.৬ বর্গ কিমি এলাকাতে  এই কয়লা মজুত রয়েছে। উপরের স্তরে কালো পাথর তোলার সঙ্গে সঙ্গে কয়লা  উত্তোলন করা হবে। এই প্রকল্পের উৎপাদিত কয়লা মূলত তাপ বিদ্যুত প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে।  

এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে এক পক্ষ খুশি হলেও, আরেক পক্ষ সিঁদুরে মেঘ দেখছে। এমনিতেই পাথরের দূষণে তাঁদের গড় আয়ু কমে গিয়েছে। তবুও কর্মসংস্থানের অভাবে, জঙ্গলের দাবি থেকে তারা একটু হলেও সরে এসেছিল। যেহেতু পুরোটাই আদিবাসীদের জায়গা, তাদের অংশীদার করে ভূসম্পদ নিত্য বৈধ অবৈধ ভাবে লুঠ হয় ওখানে। আদিবাসী শোষণ বন্ধ হয় নি। কারণ এই শোষণ চেয়েছে সভ্য সমাজ। এক শ্রেণীর মানুষ ধনী হয়েছে, কিন্তু মোটের উপর আদিবাসীরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে গেছে। আন্দোলনকেও দ্বিমুখী করে, তার অভিমুখ বদলাতে কিছু টা হলেও সক্ষম হয়েছে কায়েমী স্বার্থ

পাচামি মাইনস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের  সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিক  বলেন, "রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানায়। এর ফলে আমাদের জেলা দেশের শিল্প মানচিত্রে উল্লেখ যোগ্য স্থান করে নেবে। তবে কিভাবে প্রথমে পাথর তুলে তারপরে কয়লা উত্তোলন করা হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার এখনো হয়নি। ওই প্রক্রিয়াটি খুব জটিল।  সব পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষা করেই প্রকল্প হোক"।মহম্মদ বাজার ব্লক বিজেপি সভাপতি দীনবন্ধু কর্মকার বলেন," বহুদিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী কয়লা শিল্পের কথা বলে আসছেন কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন  কিছু হয়নি। শিল্পকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। প্রস্তাবিত এলাকায় সমস্ত মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা করতে হবে"। 

প্রশ্ন মানুষের মনে, পাথরের পর কী জন্ম নেবে নতুন করে কয়লা মাফিয়া রাজ! অন্যায়, অত্যাচার, নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। একসময়, বুধনি মার্ডি রুখে দাঁড়িয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লাশ পড়েছিল, আগুন লেগেছিল ঘরে!
 
সেই পরিস্থিতি, না পেটপুরে ভাত, স্কুল, হাসপাতাল, উন্নয়ন হবে! এই আতান্তরে আদিবাসীদের জীবনের মানোন্নয়ন হবে?
নাকি উন্নয়নের গাজর তুলে ধরা হবে আদিবাসীদের মুখের সামনে! যেখানে জীবনানন্দ দাশের সেই কথাটি সত্য বলে মনে হবে বার বার--

সে-সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়।
অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু-জনের হাতে।
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours