কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"বিজ্ঞানে প্রয়োগ হয়, প্রয়াস হয়। ব্যর্থতা হয় না।" স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
চাঁদ তখন মাত্র ২.১ কিলোমিটার দূরে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ল্যান্ডার 'বিক্রম'- এর চাঁদের জমি ছোঁয়ার কথা।
টানটান উত্তেজনায় ফুটছেন বেঙ্গালুরুর ইসরো গ্রাউন্ড স্টেশনের মহাকাশ গবেষক, প্রযুক্তিবিদরা। মনিটর থেকে মুহূর্তের জন্যও চোখ সরছে না ইসরো চেয়ারম্যান কে সিওয়ানের। ইতিহাসের সাক্ষী হতে রাজনীতির দায়- দায়িত্ব দিল্লিতে ফেলে, ইসরোতে হাজির খোদ প্রধানমন্ত্রী। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিকের ষাটজন ছাত্রছাত্রীকেও।
"পনেরো মিনিটের অবতরণ, পনেরো মিনিটের আতঙ্ক!" আগেই বলেছিলেন সিওয়ান। সেই আতঙ্ক শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

দেশটা আর বামন নেই। সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতাতেই হাত বাড়াতে পারে চাঁদ ছুঁতে। একথা বোঝা গেছিলো 'চন্দ্রযান ২'- এর প্রস্তুতিপর্বেই। চন্দ্রাভিযানের দলিলে ভারতের নাম ছ'নাম্বারে। তার আগে চাঁদ ছুঁয়েছে বিশ্বের পাঁচটি দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়া, আমেরিকা, জাপান, চীন, এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
চাঁদ নিয়ে রোমান্টিসিজমের শেষ নেই ভূভারতের মানুষের। তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার দূর থেকেই তার স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আমরা। কবির কল্পনায় বারেবারেই ঘুরেফিরে এসছে চাঁদ। কবিগুরুর উচ্ছ্বাস, 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে'। আবার একালের কবি তো সরাসরি আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন, 'চাঁদ কেন আসে না আমার ঘরে'। বলিউডের রোমান্টিক জুটি নাও ভাসিয়ে চললেন, 'চাঁদ কে পার চলো'। সম্পর্কও পাতানো হয়ে গেলো, চাঁদমামা। চাঁদই ব্যতিক্রম। বিশ্বব্রহ্মান্ডের আর কোনও পুরুষের এতো রূপবন্দনা হয়েছে বলে জানা নেই।

তা সেই চন্দ্রাভিযানে তো খরচ- খরচা হবেই। কিন্তু ইসরোর গবেষকরা প্রথম থেকেই বাজেটে কাটছাঁট বলবো না, তবে খরচ সাশ্রয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিতে মহাকাশ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদরা হাতে হাত মিলিয়ে তৈরি করে ফেলেন চন্দ্রযান ২। এর মূলত তিনটি অংশ, অরবিটর, ল্যান্ডার এবং রোভার। ল্যান্ডারের নাম দেওয়া হলো প্রয়াত মহাকাশ বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামে 'বিক্রম'। রোভারের নামকরণ করা হলো 'প্রজ্ঞা'।
চাঁদের বুকে নামার আগে দরকার মহড়া। তারজন্য দরকার বিশেষ রকমের জমি। যার সঙ্গে মিল থাকবে চাঁদের জমির। অগত্যা 'নাসা'র দ্বারস্থ হলেন ইসরোকর্তারা। 'নাসা'র ফিরিস্তিতে দেখা গেল, শুধু ওই খাতেই খরচ-খরচা দাঁড়াবে প্রায় ষাট কোটি টাকা। আর 'নাসা'মুখো হননি ভারতীয় গবেষকরা। বরং তাঁরা নিজেরা বেশ অনেকটাই কম খরচে মাটি বানিয়ে নিলেন তামিলনাড়ুর নামাক্কলে। সেখানে প্রযুক্তিবিদদের পরিকল্পনা মতোই একেবারে ঠিকঠাক 'সফট ল্যান্ডিং' করলো 'বিক্রম'।

আমাদের কাছে তখন শুক্রবারের গভীর রাত। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে সেটা শনিবার। অবশেষে প্রত্যাশা মতোই 'অরবিটর' থেকে টুক করে লাফ দিলো 'বিক্রম'। তার পেটে ভরা রোভার 'প্রজ্ঞা'। ঠিক এই মুহুর্তটিকেই আতঙ্কের বলে বর্ণনা করেছিলেন ইসরো চিফ। শুধু ইসরো নয়, গোটা দেশের হৃদস্পন্দন তখন দ্রুত। সঠিক গতি, সঠিক অবস্থানে নামতে লাগল 'বিক্রম'। 'বিক্রম'- এর সৃষ্টিকর্তারা তখন কিন্তু ঠুঁটো জগন্নাথ। ল্যান্ডার তখন তার 'আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স' দিয়ে নিজেই নিজেকে চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এ  ধরনের অবতরণে একশোর মধ্যে সফলতার স্বাদ পেয়েছে মেরেকেটে সাতাশটা।

তখন আর মাত্র দু'কিলোমিটার (২.১ কিমি) দূরে চাঁদের জমি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে 'সফট ল্যান্ডিং' করতে চলেছে 'বিক্রম'। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কেন? উত্তেজনায় দমবন্ধ হয়ে আসছে ইসরোকর্তাদের। এরমধ্যেই হঠাত রেডিও সঙ্কেত পাঠানো বন্ধ করলো ল্যান্ডার। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ইসরোর হৃদস্পন্দন। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ২.০৯। ঠিক দু'মিনিট পরেই ফের সঙ্কেত মিলল 'বিক্রম'- এর। ফের মুহূর্তেই তা হারিয়ে গেলো।

চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ ইসরোর লড়াকু বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদের। বেরিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। ডক্টর সিওয়ান এগিয়ে গেলেন মোদির দিকে। আর চোখের জল চেপে রাখতে পারলেন না ইসরো চিফ। তাঁকে বুকে টেনে নিলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদির চোখও তখন অশ্রুসজল। ইসরো চিফকে সান্ত্বনা দিলেন ভারতের চিফ।
ইসরো এখন তাকিয়ে 'অরবিটর'- এর রেডিও সিগন্যালের দিকে। সেই ডেটা বিশ্লেষণ করেই জানার চেষ্টা করা হবে, শেষ মুহূর্তে ঠিক কী ঘটেছিল 'বিক্রম'- এর।
মোট ৯৭৮ কোটি টাকার চন্দ্র অভিযান। যার মধ্যে উৎক্ষেপন বাবদ ৩৭৫ কোটি টাকা, আর বাদবাকি ৬০৩ কোটি টাকা অভিযানের খরচ। জুলাই ২২ তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস স্টেশন থেকে উড়ে যায় 'চন্দ্রযান ২'। আটচল্লিশ দিনের যাত্রাশেষে সে পৌঁছয় গন্তব্যে। তবু এবারের মতো অধরাই থেকে গেল চাঁদ।
"আপনারা এগিয়ে চলুন," ইসরোকে সকাল আটটায় প্রকাশ্যেই বললেন মোদি। "আপনাদের সঙ্গে আছে গোটা দেশ।"
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours