সুমিত তালুকদার, ফিচার রাইটার, উত্তর ২৪ পরগনা:
একদিনের
সেলিব্রিটি। সুমিষ্ট মুখ, সহাস্য বদন। ক্যামেরায় অনবরত ফ্ল্যাস, স্টুডিয়োয়
প্রশ্নবাণ। কত ঘণ্টা – বারো নাকি চোদ্দো? কতজন গৃহশিক্ষক – আট নাকি দশ?
ভবিষ্যতে – ডাক্তার – ইঞ্জিনিয়ার নাকি গবেষক? কোন দেশ স্বদেশ নাকি বিদেশ?
জীবনের প্রথম ধাপ মাধ্যমিক, দ্বিতীয় ধাপ উচ্চমাধ্যমিক। ফিবছর লক্ষাধিক
ছাত্রছাত্রী। প্রথম দশে ৫১, দ্বিতীয় দশে শতাধিক। যুগ্মভাবে প্রথম। দ্বিতীয়
স্থানেও যুগ্মভাবে। আমাদের সময় ভূতপূর্ব অনলাইন যুগে গেজেট বেরত। গ্যাটের
কড়ি খরচ করে ফলাফল জানতে হোতো। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড বা পি ডিভিসন।
পাঁচ-দশ-পনের- বিশ। যেন সিনেমার ব্ল্যাক হচ্ছে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়
একজনই হোতো। ভাগাভাগি, শেয়ার-লাইক ছিল না। ছিল না কোয়ালিশন সরকারের মতো
জোটের স্থানাধিকার। এখন দাবিদার একাধিক। এবছর উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশে ১৩৭
!!! উত্তরোত্তর বাড়বে বই কমবে না। এত কৃতী কীর্তিমান ছাত্রছাত্রী
বঙ্গসন্তান। ধন্য বঙ্গজননী। দেশের গর্ব, দশের গর্ব। এদের জন্য নামী কলেজ
উন্মুক্ত, উচ্চপদ, উচ্চশিক্ষা, মোটা মাহিনার কর্মসংস্থান পাকা, জয়েন্ট
এন্ট্রাস-এও প্রথম সারিতে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে পাঠ্যপুস্তক
প্রকাশনীর বিজ্ঞাপনেও সহাস্য সগর্ব উপস্থিতি।
আর
অধিকাংশ বাকীদের কি হবে? বেকারদের দলে নাম লেখাবে, অর্ধশিক্ষিত হয়ে
ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকবে, ১০০ দিনের কাজে যোগ দেবে, কন্যাশ্রী- যুবশ্রী
প্রভৃতিতে নাম নথিভুক্ত করে সাময়িক অর্থপ্রাপ্তিতে খুশি থাকার চেষ্টা করবে,
পার্টিতে নাম লেখাবে আর ঝান্ডা হাতে দলের হয়ে প্রচার করবে, মিছিল করবে।
গৃহশিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ঘরে ঘরে শিক্ষকদের কুটীরশিল্প হবে।
শিক্ষা ও শিক্ষকদের গুনগত মান ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করা বৃথা। এছাড়া আছে
সংবাদপত্রের দৌলতে ব্যতিক্রমী সংবাদের পরিবেশনায় কিছু সহানুভূতির কোটা।
যেমন –“ জামার টাকায় বই কিনতেন সংযুক্তা, কাগজ কুড়ানি জিতেন উচ্চ মাধ্যমিকে
স্টার, ছাত্র পড়িয়ে আরও টাকা জোগাড়ের চেষ্টা, মায়ের পরিশ্রমে সফল
স্নায়ুরোগে আক্রান্ত ছেলে, টোটোচালক – সাফাইকর্মীর ছেলে সপ্তম,
দৃষ্টিপ্রদীপ জ্বালিয়ে অনন্য নজির, অভাবী মায়ের দুঃখ ঘোচাল খাটুরার মৃন্ময়
.....”। (তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়, ২৮/০৫/২০১৯) অভাব, অনটন,
অভিযোগ সর্বত্র। সুতরাং তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। সহানুভূতির কোটায় এরা
হয়ত কিছু সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য লাভ করলেও অসম লড়াই –এ এরা
সার্বিকভাবে সাফল্যলাভ একদিন করবেই – এমন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আমাদের যেন
অক্ষুণ্ণ থাকে।
প্রতি বছর লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রীর
মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী কৃতী বঙ্গসন্তান একদিনের সেলিব্রিটি হয়ে সমাজ-
পরিবার শিক্ষাদপ্তরের মুখ উজ্জ্বল করবে, সংবাদপত্রের শিরোনাম টিভি-র পর্দায়
সহাস্য সগর্ব সমুজ্জ্বল উপস্থিতিতে সামিল হবে, বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাবে,
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশসেবা (আশা করা যায়)-য় আত্মনিয়োগ করবে। আর আমরা
অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন- মধ্যবিত্ত, কুলি- মজদুর, ভ্যান-টোটোচালক বিড়ি-
চাবাগান শ্রমিকের ঘরের বাবা-মা আমাদের মিড-ডে মিলভোজী ছেলে-মেয়েদের দেওয়ালে
ঝুলন্ত মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সেলিব্রিটিদের ছবি দেখিয়ে তাঁদের পদাঙ্ক
অনুসরণ তাঁদের আদর্শ অনুকরন করার পরামর্শ দেব।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours