পারমিতা মালী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কোন্নগর:
সবাই
যেমন একটা করে দিন পায়, কালেক্রমে শিক্ষকরাও একটা দিন পেয়েই গেছে। ফিফথ
সেপ্টেম্বর। রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন। শিক্ষকেরা জাতির মেরুদণ্ড, মানুষ গড়ার
কারিগর, হাবিজাবি অনেক কিছু বলা হয় বটে, তবে মন থেকে বোধহয় মানে না। নইলে
এতোখানি বেইজ্জতি হতে হয়?
আচ্ছা,
এরকম কখনো হয়েছে, যে আপনার অত্যন্ত পছন্দের ডাক্তারটি আপনাকে ডাইজিন গুঁড়ো
করে খাইয়ে দিলেও আপনার ডায়েরিয়া সেরে যায়, অথচ অচেনা ডাক্তারটা কিছুতেই
আপনার সামান্য জ্বর সর্দিকাশি সারাতে পাচ্ছে না?
হবেই
তো! হতেই হবে! ওই অচেনা লোকটা (ডাক্তারটা) কি আপনার ধাত চেনে? মোটেই চেনে
না সে! আর ওই চেনা ডাক্তারটি? আপনার ফোনে যার নাম্বারটি গত কুড়ি বছর ধরে
উপরের দিকে থাকে? সে আপনার ধাতটি চেনে! সে আপনাকে সারাতে পারবে না? তাকে
দেখতেও হবে না, শুধু ফোনে দুটো কথা বলে দিক, তাতেও আপনি সেরে যাবেন। ওই
অচেনা ডাক্তারটি কিছুতেই আপনাকে সারাতে পারবে না!
এটা
আর কিছু নয়, ইটস এ ম্যাটার অফ বিশ্বাস। যার সঙ্গে যার হৃদয় বাঁধা। হৃদয় যে
ঠিক কোন নিয়মে,তাও ছাই বোঝা যায় না! পছন্দ ব্যাপারটাই গোলমেলে। অনেকটা
ভুতে পাওয়ার মতো। কখন যে কে কাকে পেয়ে বসে, কিচ্ছু ঠিক নেই! তা বিশ্বাস
বিশ্বাস ব্যাপারটাও কি কিছু কমদামী ? বিশ্বাসের ওপর ভর করেই না চলছে গোটা
দুনিয়াটা!
অন্য ডাক্তার
ডাক্তারি জানেন না, তাও নয়।আপনাকে ভুল ওষুধ দিচ্ছে, তাও নয়, কিন্তু আপনি
কিছুতেই সারছেন না তার কাছে ! টাকা কে টাকাও গেলো, লাভের লাভ কিচ্ছুটি হলো
না! আসলে আপনার হৃদয়টি বাঁধা আছে সেই পুরোনো লোকটির বুকপকেটে। সে যা বলবে,
তাই বেদবাক্য।
এবার
ডাক্তারের জায়গায় শুধু একবার টিচার বসিয়ে দিন, দেখবেন কেস কেমন ঘেঁটে ঘ হয়ে
যায়! ডাক্তার পয়সা নেয়, চামার, রক্তচোষা, সব ঠিক। তবু কিছু তো কাজ করে
মশাই ? আর টিচাররা? কিচ্ছুটি কাজ করে না! আসে যায়, মাইনে নেয়। নম নম করে
স্কুলের চাকরিটা বজায় রাখে, আর খালি পার্টিবাজি করে যায়! এই হচ্ছে শিক্ষক।
তাদের নিয়ে একটা গোটা দিবস?
শিক্ষকত্বের
মধ্যে সত্যিই তেমন মহত্বের কিছু নেই। অন্য সব পরিসেবার মতো, শিক্ষাও একটা
পরিসেবা মাত্র। কর্মীদের সদিচ্ছা আর কর্মক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এই
পরিসেবার ভালোমন্দ। আমার দেশের বাকি পেশাগুলোর মধ্যে যতটা বেনোজল আছে, এ
পেশাতেও ঠিক ততটাই আছে। তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নেই! সরকারি চাকরিতে চাকরি
যাওয়ার ভয় থাকে না,ফলে আলস্য তৈরি করে দেয় এই পেশা। আবার একই সঙ্গে টার্গেট
বলেও কিছু থাকে না। যে যেমনই খাটো, মাইনে একই। ফলে খাটার ইচ্ছেটাও যায়
কমে। দুচারজন কর্মবীরদের কথা নাহয় বাদই দিলুম।
তা
এই বাজারে, ধানাইপানাই করে, কত আর সম্মান আদায় করা যায় বলুন? তবে দিনকাল
বদলাচ্ছে। স্কুলগুলোতে হাজার রকম শ্রী এর ঠেলায় এখন নাজেহাল অবস্থা!
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, গুণশ্রী, বিদ্যাশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী, কতরকম যে
শ্রী ! এতো শ্রীএর ঠেলায় স্কুলের কতটা শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে খোদায় মালুম,
কিন্তু শিক্ষকদের ক্লারিক্যাল কাজ গেছে বহুগুণে বেড়ে গেছে! আমাদের এখন
সবসময়ের কাজ হলো,...দেখি দেখি তোর মাথাটা দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে?...
যখনই দ্যাখো, কাজকম্ম শিকেয় তুলে, এই তোর নাম কি রে?.... বাবার নাম কি
রে?... আধার কই রে ?...ছবি কই?...কাস্ট সার্টিফিকেট নেই?.... পাসবই
দ্যাখা....এই করে যাচ্ছি আমরা! এইসব কাজ আর শেষ হয় না!
তা
সেও নাহয় বড় কথা নয়, যে জমানায় যা নিয়ম। কিন্তু মুশকিলটা হয়ে যাচ্ছে অন্য
জায়গায়! নলেজ জিনিষটা আমাদের মাথায় যে প্রকোষ্ঠের মধ্যের থাকে, সেটা খোলার
দরজা একমাত্র শ্রদ্ধা বা বিনয়। অন্য কোনো ভাবে সে দরজা খোলা যায় না! আপনি
যদি মনে মনে আমায় বাচ্চা শুয়োর ভেবেই বসে থাকেন, আমি হাজার চেষ্টা করেও
আপনাকে কিচ্ছু শেখাতে পারব না! কারণ ওই শেখার দরজাটা ততক্ষনে বন্ধ হয়ে
গেছে! আমার যাবতীয় কথা ওই দেওয়ালে ধাক্কা খাবে শুধু, ভেতরে ঢুকবে না।
আপনার
অপছন্দের ডাক্তারটি আপনাকে ভুল বা ঠিক, যাই ইঞ্জেকশন দিক না কেন, আপনার
শরীরে ভুল বা ঠিক যাহোক একটা কিছু ক্রিয়া হবেই। এটা বস্তুগত ক্রিয়া। এর
মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নেই। বিশ্বাস বড়জোর ক্যাটালিস্টের
কাজ করে। কিন্তু আপনার অপছন্দের শিক্ষকটি হাজার করেও আপনার মধ্যে দু ইঞ্চি
জ্ঞানও ঢোকাতে পারবে না! আপনার অশ্রদ্ধার ওই দেওয়ালই আটকে দেবে তার
সমস্তরকম প্রচেষ্টা । নলেজ ওই দেওয়ালে ধাক্কা খাবে মাত্র, ভেতরে ঢুকতে
পারবে না।
মাননীয়
অভিভাবকরা, দয়া করে আমার এই ছোট্ট কথাটি মনে রাখবেন। আমরা জানি, আমরা অতি
খারাপ লোক। অতি অপদার্থ, ফাঁকিবাজ আমরা! কিন্তু প্লিজ, এই অত্যন্ত জরুরি
কথাটি আপনার ছেলেমেয়েদের বলে দেবেন না! দোহাই আপনাদের, ছেলেমেয়েদের সামনে
আমাদের নিয়ে নিন্দেমন্দ করবেন না! ওদের আড়ালে বলুন। যা খুশি বলুন, কিন্তু
ওদের সামনে নয়! সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে! আপনার ছেলেমেয়ে আর তার শিক্ষকের
মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে দুর্ভেদ্য এক দেওয়াল! আমাদের যতটুকু যা দুচার আনা
জ্ঞান আছে, সমস্ত কিছু ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে ওই দেওয়াল থেকে। এটা আমাদের
অপদার্থতা নয়, অসহায়তা! কিচ্ছু শেখাতেই পারব না আমরা! বাবা মা হয়ে,
ছেলেমেয়ের এই সর্বনাশ করবেন কি?
প্লিজ.... ভেবে দেখবেন একবার....
আর
একটা কথা। দেহের যেমন পুষ্টি লাগে, মনেরও পুষ্টি লাগে অনবরত। আপনার
সন্তানকে সেই খোরাকটুকু দিন। ভালো লেখা, কালজয়ী গান, সিনেমার সাথে পরিচিতি
করান দেখবেন ও নিজে থেকেই গ্রহণ করে নেবে ওর খাদ্যরস।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours