শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে এসে বাংলাদেশের  প্রসাশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সমকামিদের মানবাধিকার ও সমকামী অধিকার কর্মি খুনের বিচার না হওয়ার কূটনৈতিক ভাষায় তুলোধূনো করলেন বাংলাদেশের বিচার ব্যাবস্থাকে। ভিন্ন চিন্তা ও মতের প্রতি রক্ষণশীদদের বিপদজনক  আচরন ও সরকারে সমকামিদের অধিকারের প্রতি উদাসিনতায় ক্ষুব্ধ মার্কিন প্রসাশন।

আমি ছোট বেলায় হিজড়া দেখলে ভয়ে দৌড় দিতাম। যদিও আশির দশকে মফস্বলে খুব কমই হিজড়া দেখা যেতো। তারপর যখন আমার  শহরে আসা যাওয়া শুরু হলো তখন জানতে পারলাম, হিজড়া সম্পর্কে। আমার স্পষ্ট মনে আছে কিশোর বয়সে প্রথম আমাকে গাল টেনে টেনে চুমু দিয়েছিলো একজন হিজড়া! বলেছিলো "এই কালু ( আমি কালো বলে কালু ডেকেছিলো) তর বউ তরে যা আদর করবো না! " তবে তখন আজকের মত হিজড়াদের এত চাঁদাবাজি ছিলো না। সাধারন মানুষ এত বিরক্তও হতো না। বরং কি নারী কি পুরুষ;  হিজড়াদের  বিচিত্র আওয়াজ, এমন কি অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি দেখেও মানুষ আনন্দই পেতো মনে হয়।

 আমার কয়েকজন  বন্ধুকে দেখতাম হিজড়া সেজে মজা করতো। আমার এক বন্ধুর বড় ভাই তো হিজড়াদের মত হুবহু  অভিনয় করায় বিখ্যাত ছিলেন । আামাদের হাইস্কুলের ছাদ ঢালাই করার সময়ও দেখতাম একজন পুরুষ হিজড়াদের মত সেজেগুজে নাচতো! 
  আমরা সিনেমাতেও কমেডিয়ানদের হিজড়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখি। কখনো কখনো তো সুপারস্টারেরাও হিজড়ার ভূমিকায় অভিনয় করে থাকে। 
এক সময় হিজড়াদের সমাজে সম্মান দেয়ার জন্য, তাদের তৃতীয় লিঙ্গ বলে ঘোষণা করা হয়।  তাদের নিয়ে গল্প,নাটক তৈরি হতে থাকে। টিভি ও পত্রিকাগুলো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এনজিওগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। ভারতে যদিও সবচেয়ে বেশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বসবাস। তবে, বাংলাদেশেও নেহায়েত কম নয়। যদিও মাঝে মাঝে পত্রিকা ও টিভি নিউজে ছদ্মবেশি  তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষের খবর পাওয়া যায়। 

কথাগুলোর অবতারনা এ জন্য করলাম; 
চার সেপ্টেম্বর বিকেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামজিক বিজ্ঞান অনুষদে। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ; বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মি আর্ল রবার্ট মিলার, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীনের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বয়ান’র মোড়ক উন্মোচন করেন।
গ্রন্থটিতে তৃতীয় লিঙ্গের জীবন যাপন, স্বপ্ন- আশা, আকাংঙ্খা তাদের সফলতা ব্যার্থতা প্রভৃতি তুলে ধরা হয়েছে। সন্দেহ নেই তৃতীয়বিশ্ব সহ, রক্ষনশীল দেশগুলোতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন যাপন খুবই কঠিন ও নির্মম। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো কেবল, সমাজের চোখেই হেয় প্রতিপন্ন হয় না। প্রথমে নিজ পারিবারেও তারা অবাঞ্ছিত হয় !  'অভিশপ্ত'  বলেও তাদের পরিবার তাদের অপাংক্তেয় মনে করে। ধর্ম, প্রথা, কুসংস্কারের কারনেও চরম অনহেলার শিকার হয়।  এমনকি প্রধান অতিথি  মার্কিন রাষ্ট্রদূত  বলেছেন, তার দেশেও তৃতীয়লিঙ্গরা কখনো কখনো অবহেলার স্বীকার হয়। একটি শিক্ষিত, উন্নত, সভ্য  রাষ্ট্রেই যদি তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ বঞ্চনার শিকার হয়, তাহলে রক্ষণশীল ও পিছিয়ে পরা সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সহযোগী অধ্যাপক, লেখক  জোবাইদা নাসরীন তার গবেষনা  গ্রন্থটি লিখে চেষ্টা করেছেন ; যাতে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ; তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক হয়, সুস্থ হয়, মানবিক হয়।

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত "লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বয়ান "  গ্রন্থটির  মোড়ক উন্মোচন সময় আরো কিছু বিষয় সংযুক্ত করেন। তা হলো, রুপবান পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস ও তার বন্ধুর খুন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। রুপবান সমকামীদের  প্রচার ও অধিকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ক সাময়িকী। "রুপবান" নারী ও পুরুষের সমকামের  বৈধতা ও আইনি  স্বীকৃতি চেয়ে আন্দোলন করতো। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন নারী ও পুরুষের সমকামিতা আইনত বৈধ। এই তো কিছু দিন আগে প্রতিবেশি দেশেও সমকাম বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্রুনাই সমাকামিদের মৃত্যুদন্ডের  সাজা ঘোষনা করলে, সমকামিরা সে দেশ ছাড়তে থাকে।।আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ব্রুনাই সমাকমের অপরাধে মৃত্যুদন্ড রহিত করতে বাধ্য হয়।  
মার্কিন রাষ্ট্রদূত, জুলহাস মান্নান হত্যার সূষ্ঠূ বিচারের জন্য  তদন্ত প্রতিবেদন  দেয়ার দাবি করেন। রাষ্ট্রদূত নিজেও বাংলাদেশের প্রতি নিজ মাতৃভূমির ভূমিপুত্রের মত টান অনুভব করেন বলে জানান। তিনি  অনেকটা বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন, কেন এখনো জুলহাস হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। মূলত এর মাধ্যম তিনি  ভিন্ন মতের প্রতি সহিংসতার বিচারহীনতার বিষয়টিই সামনে তুলে ধরেন। তরুনদের ভাবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতা হিসেবে উল্লেখ করে, এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ভাঙন ও মতানৈক্যের করাল গ্রাস যেসব লোক দেখতে আমাদের মতো নয়, যারা আমাদের মতো কথা বলে না কিংবা উপাসনা করে না তাদের আমাদের থেকে দুঃখজনকভাবে বিভক্ত করে।" মূলত তিনি ভিন্নমত, ভিন্ন আচরন, ভিন্ন জীবন যাপনেে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে তা -ই বলতে চেয়েছেন।

উল্লেখ্য ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল বাংলদেশের রাজধানী ঢাকায়, কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের বাড়িতে  জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয়  খুন হয়। তারা পরস্পর বন্ধু ছিলো। জুলহাস  ইউএসএইডের সাবেক কর্মকর্তা এবং সমকামী অধিকার কর্মী।
জুলহাস  মান্নান বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তাও ছিলেন। জুলহাসের বন্ধু মাহবুব তনয়  ছিলেন  থিয়েটার কর্মী। জঙ্গি সংগঠন  আনসার উল্লাহ বাংলা টিম তাদের কুপিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয় ।

স্মর্তব্য  জুলহাস মান্নান ও তনয় হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন  ৩৩/৩৪ বারের মত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে  মার্কিন প্রশাসন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
পৃথিবীতে সব মানুষই এক রকম  চিন্তা  চেতনা আচ্ছন্ন থাকবে না। একই ভাবে জীবন যাপন করবে না এটাই স্বাভাবিক। আমরা যারা সমকামি নই, অথবা সমকাম পছন্দ করি না। তাদের দৃষ্টিতে সমকাম অস্বাভাবিক যৌন ক্রিয়া মনে হলেও; একটি সমকামি জুটি তা মনে করে না। আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না যে, আমরা  যারা কি শহর কি গ্রামে থাকি, আমাদের আশে পাশে থাকা দু একজন সমকামিকে চিনি না! সমকাম বিকৃত কিছু নয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সমাকামিদের কাছে। সমকামি কেবল পুরুষেরা নয়, নারীরাও সমকামি হতে পারে। আমার কিশোর বেলার এক বান্ধবীকে দেখতাম আর এক বন্ধুর বড় বোনের সাথে সমকামে লিপ্ত হতে। ("টিলো এম্প্রেস"   খেলার সময় লুকোতে গিয়ে বিষয়টি আবিস্কার করি!) তখন তো বুঝতাম না সমকাম কি। আর নারীরাও যে সমকামি হতে পরারে তা,তো বোধেই ছিলো না। কিশোর বয়সে নাচ শিখতে গিয়ে তো নাচের শিক্ষকের অদ্ভুত আচরন দেখে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন প্যাসিভ সমকামি। 

বাংলাদেশে নারীদের সম্ভব হলে ঘরেই বন্দী রাখা হতো। ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্বই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে গ্রহন করা হয় না। বিয়ের আগে নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসা, জৈবিক চাহিদাকে অনেকটা ট্যাবু করে রাখা হয়েছে।  সেখানে একজন  জুলহাস মান্নানের সমাকামিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলা কত ঝুকিপুর্ন তা তিনি ও তার বন্ধু মৌলবাদী রক্ষনশীলদের হাতে খুন হওয়ার মধ্যদিয়েই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে কোন খুনের বিচার হওয়া জরুরী। তা না হলে বিচার ব্যাবস্থা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত, জোবাইদা নাসরিনের গবেষণা "লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বয়ান" গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে তাই বলতে চেয়েছেন।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours