শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

বই দেখলে এদেশের অনেকেই ভয় পায়। এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন করে রাখা হয়েছে  যে, একটি শিশু ছোট বেলা থেকেই বই ভীতি নিয়ে বড় হতে থাকে। সব  মানুষ বোধয় বই পড়াকে ভয় পায়।  সে কারনে মনে হয়, স্বর্গেও বই রাখার হয়নি! 

আমাকে একজন লিখেছেন; তিনি "বেশি লেখা" দেখলেই ভয় পান। "মোটা বই" পড়তে তার ইচ্ছা করে না। আমার লেখা পড়তে ইচ্ছা হয়। তবে  আমার ছোট ছোট লেখাসমূহ  তিনি পড়েন। বড় লেখা পড়েন না। যাক  বাবা! বুঝা গেলো তিনি ছোট লেখা, ছোট বই  অন্তত পড়েন। আজকাল তো মানুষ বই কেনা ও বই পড়া ছেড়েই দিয়েছে। অন্তত বাংলাদেশের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য।  তার রাজ সাক্ষী যারা আমিও তাদের একজন। কেন না, জেলায় জেলায় বই গাড়ির সাথে বই বিক্রি করতে গিয়ে আমার কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য বাঙালিদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনো হাতের কাছে বই পেলে পড়ে। সাধ্যের মধ্যে  হলে কেনেও। 

বই উপহার দেই বলে আমাকে সাধারনত কেউ আর নিমন্ত্রণ করে না। আমেরিকান একটি টিভি শোতে দেখলাম, ছ বছরের একটি মেয়ে শিশু আড়াই হাজার বই পড়ে ফেলেছে! আমার এক বন্ধু নিউইয়র্কে থাকে। সে বলছে তার ছোট্ট মেয়ে গত কয়েক বছরে যতগুলো বই পড়েছে। সে নিজেও তা পড়েনি। এমন কি আমাকে বললো, "দোস্তো বই পড়ুয়াদের জন্য আমেরিকা স্বর্গরাজ্য! এই দেশে তোমার আসা দরকার ছিলো। " 
ওমর খৈয়ামের কবিতায় আমরা দেখেছি; রুটি নারী, মদের পাশাপাশি  বইও চেয়েছেন। বই পড়া আমাদের দেশে 'সময় নষ্ট'  বলে মনে  করা হয়। বাংলাদেশ  রেল মন্ত্রনালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি নিজে লেখকও। একদিন বই মেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, তার সহকর্মিরা নাকি অভিযোগ করেছেন; তিনি কি অফিসে কাজ কর্ম করেন না!লেখা লেখির সময় পান কোথায়? 

গত কয়েক দিন আগেও, আরেকজন লেখক তার বই নিয়ে আলোচনার মাঝে বলেন, তাকে তার সহকর্মীরা বলেছেন, সময় পান কোথায় এত লেখা লেখির?  তিনি কৈফিয়তও দিয়েছেন সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে।  জবাবে, বলেছেন; আমি তো আট ঘন্টা কাজ করি। তারপর ব্যক্তিগত কাজ কর্ম সেরে কিছু সময় প্রতিদিন পড়া ও লেখায় ব্যয় করি। তিনি আরো বলেন, একটি বই লিখতে গেলে ৫০/৬০ হাজার টাকা খরচ হয় কেবল, তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করতেই। ছাপা খরচ তো আলাদা বিষয়।

দুজন উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিকেই যদি বই লেখার জন্য এমন আক্রমণের শিকার হতে হয়  আরেক উচ্চ শিক্ষিতের দ্বারা । তাহলে আমার মত ছাপোষাদের কি হাল তা অনুমান করে নিন। পরিচিতরা আত্মীয় স্বজনরা তো অহরহ বলেই থাকে বই পড়ে কি লাভ? ঘরের লোকজন তো বেজায় ক্ষ্যাপা লেখা লেখি করে তো টাকা পয়সা পাওয়া যায় না। কি দরকার বেগার খাটার!  সত্যিই তো? বই পড়ে কি লাভ! লেখেই বা কতটুকু ফায়দা পাওয়া যায়? সম্ভবত একারনেই,  সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়ালেখা করা তরুন-তরুনিরা গাইড বই পড়ে কেবল  বিসিএস ক্যাডার হতে চায়! 

আসলে যে কাজ করলে সন্মান নেই (?) অর্থও নেই ; সে কাজ মানুষ করবে কেন? বর্তমান সমাজে যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করলেই সন্মান, যশ, খ্যাতি, ক্ষমতা সবই পাওয়া যায়। তাহলে, কে সময় ও অর্থ খরচ করে বই পড়তে যাবে! লিখতে যাবে? 

ইন্দোনেশিয়ানেরা নাকি বই পড়ে না। তারা মনে করে যারা বই পড়ে তারা তারা শোষক ও বাটপার হয়। জাকার্তার লোকেরা নাকি মনে করে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। 

তবে, সত্য হলে এই, বই পড়াই কেবল  একজন ব্যাক্তি ও একটি জাতিতে রাতারাতি বদলে ফেলতে পারে।  আল কোরআনের প্রথম শব্দই "ইকরা,' মানে পড়।  ইসলামে নামাজ ফরজ ( অবশ্য কর্তব্য) হওয়ার এগারো বছর আগে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ বলা হয়েছে। যদিও "মোল্লাদের দোকানদারী " খোলা রাখার জন্য কেবল, নামাজ ফরজ, নামাজ ফরজ বলা হয়। জ্ঞান অর্জনও যে ফরজ তা সাধারনত বলতে চায় না। 
ভারতবর্ষে অমৃত সঞ্জীবনী খুজতে  এসেছিলেন ইরানের বাদশা নওশেরার এক উজির । বাদশার পত্র সাথে ছিলে বলে ভারতবর্ষের রাজারা তাকে সহযোগীতা করে। কিন্তু তিনি তার কথিত সেই অমৃত সঞ্জীবনী খুজে না পেয়ে, ব্যার্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। তখন এক ঋষি তাকে দেখে প্রশ্ন করেন তার মন খারাপ কেন? উত্তরে উজির বলেন, আমি আমার বাদশাকে বলেছিলাম, ভারতবর্ষে অমৃত সঞ্জীবনী পাওয়া যাবে। আমার পরামর্শে বাদশা আমাকে ভারতবর্ষে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি তা খুজে পেতে ব্যার্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি। তাই আমার মন খারাপ। ঋৃষি পারস্যের উজিরকে বলেন, আপনি, তা পাবেন তবে আপনার অর্থ বুঝতে ভুল হয়েছে। অমৃত সঞ্জীবনী হচ্ছে জ্ঞান ভান্ডার। যার কিছু অংশ রাজার সিন্দুকে রক্ষিত আছে।  আপনি যেহেতু ভিনদেশী অতিথি।  তাও আবার পারস্যের বাদশাহর পত্র নিয়ে এসেছেন । তাই আপনাকে তা দিতে পারে। উজির, ভারতীয় রাজার কাছে সেই জ্ঞান ভান্ডার থেকে কিছু সংগ্রহ অনুদান আশা,করেন। কিন্তু রাজা তার অনুরোধ রাখলেও অনুলিপি করে নিতে বলেন। উজির অতপর লোকজন দিয়ে অনুলিপি তৈরী করে পারস্যে ফিরে যান ভারত বর্ষের অমূল্য জ্ঞান ডান্ডারের অনুলিপি নিয়ে। আজকে যাযাবর দেশহীন ইসরাইলীরা  জ্ঞানে বিজ্ঞানে কোথায় চলে গেছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই।  মানুষ এবং পৃথিবীকে বদলাতে পারে কেবল জ্ঞান। আর জ্ঞান, এ আধুনিক যুগে বই আকারে সংরক্ষিত।  

ইতিহাস ও সভ্যতাকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। মানুষের সৃষ্টি, মানুষের অতীত বর্তমান,  জীবন -জীবিকা জানতে হলে বই পড়তে হবে। মানুষের ভবিষ্যৎ কি তা জানতেও বই পরতে হবে। আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান  বাংলাদেশ অঞ্চলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো! যখন আজকের  ইউরোপ ছিলো অনেক অনেক পিছিয়ে। আজ তারা কোথায়  আর আমরা তথা  ভারত পাকিস্তান, বাংলাদেশ কোথায়? যে জাতি পড়বে না। তার নিজস্ব ইতিহাস  ঐতিহ্য  জানবে না।  তারা আর যাই হোক পৃথিবীতে কখনোই শিক্ষা ও সভ্যতার শিখরে উঠতে পারবে না। বই পড়ার বিকল্প নেই। দাসত্বের শৃংখলা মুক্ত হতেও পড়তে হয়। বই পড়লে কেবল জ্ঞানই বাড়ে না, শীড়দাঁড়াও মজবুত হয়। যত শক্তিমান সামনে থাকুক বই পড়ুয়াদের, লেখকদের কেউ দাসত্ব  করাতে পারে না। যদি না সে স্বেচ্ছায় দাসত্ব মেনে না  নেয়। অন্তত, সাহসী হতেও বই পড়ুন। কেবল চাকুরীর জন্য বই পড়া নয়।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours