কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

শা... লা মানুষ, নাকি গিরগিটি রে বাবা?
এতো রং বদলায়।
আবার হাওয়া মোরগও হতে পারে!
সরি সরি, মোরগ না হয়ে মুরগিও হতেই পারে- হাওয়া মুরগি। লিঙ্গ বৈষম্যের এতটুকু জায়গা নেই আধুনিক সভ্য সমাজে। নারী পুরুষ সমান সমান। আচ্ছা তাই যদি হয়, তাহলে এই ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যাপারটা কী?
তা যাই হোক, হাওয়া মোরগ হোক বা মুরগি ব্যাপারটা একই। এই পূবমুখী তো পরক্ষণেই পচ্ছিম। দিকবদলও তো রংবদল।

আজ তৃণমূল, কাল বিজেপি। আবার কাল কংগ্রেসী তো পরশু তৃণমূল। দিকবদল। রংবদলও বটে। সবাই গোল দিতে চায়। তাই লাল-হলুদ জার্সি ছেড়ে, সবুজ-মেরুনে। জার্সিবদলের সঙ্গেই হাওয়ামুরগির মতো দিকবদলও। আগে ডানদিকে গোল দিতেন, এখন বাঁদিকে। মোটকথা গোল চাই গোল। সব চলে বাজার বুঝে। বাজারই ঠিক করে দেয় মানবচরিত্র।

রং বদল হোক, কী বাতাসের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিকবদল, গোটাটাই স্বীকৃত আধুনিক সমাজে। আর হবেই বা না কেন, গত এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার বছর ধরে এই তো চলেছে। রংবদল, ভোলবদল। 'হোমো এরেকটাস' থেকে 'হোমো স্যাপিয়েন্স' ওঠার কাহিনি। তারজন্য আবার রাগ কিসের? 
গিরগিটির ওপরে মানুষ রাগে নাকি? মুরগির ওপরেও না। মানুষ তো মুরগি  পোষে। যার শখ সেই পোষে। ডিমের লোভে। যতদিন ডিম পাড়ে, ততদিনই মুরগির রংবাজি। যেদিন ডিম পাড়া বন্ধ, সেদিন মুরগির মালিকের রংবাজি। মুরগি চালান পেটে। সেই রংবদল। কালকের পালক আজকের ঘাতক। 

বরং রাগ ধরে নিজের ওপর। গোটা গায়ে কেমন যেন ম্লেচ্ছ মার্কা গন্ধ। ওই মুরগিপ্রীতির ফল। বড্ড ভালো লাগে চিকেন। ওই পালক ওঠা, গোলাপি চামড়া উঁকি দেওয়া মুরগি। বিষ্ঠাময় পেছন। বাজারের মুরগিও এক অতি বিষম বস্তুবিশেষ। বস্তু ছাড়া আর কিই বা বলি! যেমন ভাবে টান মেরে মাথা ছিঁড়ে ফেলে! কোথাও বা আড়াই পোঁচ। কাঠের মুগুরের এক ঘা। ফুটন্ত জলে জ্বলজ্যান্ত মুরগি চোবানো। সে হাজারো কায়দা। তাই বস্তু বলে মানবজাতির দোষখন্ডন করাই ভালো। কিন্তু বড়ো অদ্ভুতএই বস্তুটি। জীবিত থাকতে দুর্গন্ধ। পাতে পড়লেই সুগন্ধ। নিকৃষ্ট মুরগির এ কেমন পাল্টি খাওয়া বলুন দিকিনি!

আর দাঁত কেলিয়ে চিকেনের লেগপিস খায়নি, এমন দুস্থ ব্রাহ্মণ বিরল প্রজাতির। পাল্টি খেয়ে বামুন তখন, মুরগিকে বলে রামপাখি।

বড্ড নোংরা মনে হয় নিজের শরীরটা। জানেন, বেশ নোংরা। পূতিগন্ধময়। কর্পোরেশনের চারদিন সাফ না হওয়া ডাস্টবিন। রাত যখন স্তব্ধ। আকাশের কালপুরুষও পরে ঘুমিয়ে। তারারা মিটিমিটি তাকায়। কেমন ভোলবদলে ফেল গভীর রাতের আকাশ। বারুদগন্ধময় বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড তখন গম্ভীর, ধ্যানস্থ। শরীরের সব রিপু নিদ্রায়। ঠিক তখন, কেমন যেন একটা পাঁকের গন্ধ পাই আমার নিজের, এই ভালবাসার শরীরে। অথবা বৃষ্টিতে দুদিন ধরে না শোকানো লুঙ্গি অথবা গামছার বোটকা গন্ধ। ঘেন্না ঘেন্না আর তীব্র ঘেন্না।
তাড়াতাড়ি সিগারেটে আগুন দিই। কড়া তামাকের গন্ধে  চাপা পড়ে শরীরে লেপটে থাকা গন্ধ। দেহের গন্ধবদল!

সকালে উঠেই কী পরম নিষ্ঠাভরে কোঁকর কো- গুড মর্নিং। ফেসবুকে ভক্তদের শুভকামনার পোস্ট। শব্দের ছবিগুলোও পাল্টেছে। এখন আর কেউ গুড মর্নিং পুরো শব্দটা লেখে না। ফেবু, বিএফ, জিএফ দের বাজার এখন। চর্বিছাঁটাই অভিযান। নিজেদের তলপেটে চর্বি বাড়ছে। শব্দের চর্বি কমছে। সেই ভোলবদল চক্রের খেলা।

তারপর তো সারাদিন কমেন্টের বান। লাইক। বিচার বিশ্লেষণ। কুকুরের প্রোমোশন। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম জীব। সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই। কনসেপশন চেঞ্জড। সৌজন্য কুকুরপ্রেমীদের। কিন্তু মুশকিল একটাই, পাড়ার ভুলু কালুরা মনুষ্যসমাজে এতদিন সহবাস করেও রংবদল শিখলো না। এখনও আগন্তুক দেখলেই ঘেউ ঘেউ। আর একটু প্রশ্রয়েই লেজ নাড়া। পশুসমাজে রংবদল ভোলবদল কোনটাই নেই। সুযোগ পেলেই হলো, হুলো হোক অথবা মেনি, দুধ চুরি করবেই।

সকালে উঠেই জাল ফেলা সোশ্যাল মেডিয়ায়। রাতে শুতে যাওয়ার আগে 'গুড নাইট' জানিয়ে জাল গোটানো। জালে ফাঁসা মাছের ছটফট। কপালে থাকলে, কয়েকদিন প্রেমের অ্যাকোরিয়ামে বন্দি। শখ মিটে গেলে পেছনে লাথি। তসলিমার সেই কবিতা, 'যা শালা ভাগ!' 
চাইকি দু-চারটা রানাঘাটের রানু উঠলেও উঠতে পারে। তারিফের সুনামি। কয়েকদিন গেলেই নিন্দার সাইক্লোন। রংবদলের খেলা।
সকালের ফেবু ফ্রেন্ড, দুপুরে বিএফ জিএফ। রাতে শত্রু। সম্পর্ক বদল।

প্রথম দিকটায় মনখারাপ হতো। রাগ ধরতো। ইচ্ছে হতো ফাটিয়ে ঝগড়া করি। কামড়ে দিই মুখটায়। ওই মুখের মিষ্টি হাসি মিষ্টি কথা দিয়েই তো রুই কাতলা বধ করিস। এবার মজাটা বোঝ!
মনে হতো চুলের মুঠি ঝাঁকিয়ে বলি, মেসেজগুলো কি মাল খেয়ে লিখতি? কত অত্যাচার সইবার বৃত্তান্ত। ঠিক যেন মা সীতা। এতদিন সব শুনেই যেতাম। তারপর আঠারোটা সিট পেতেই একদিন রাম সাজলাম। লঙ্কা থেকে তোকে উদ্ধার করবোই। 
কিন্তু একি তুই তো উল্টো গাইলি! অবাক আমি। পালানোর পথ খুঁজে পাই না। কলির সীতার পছন্দ রাবণ। সোনা আছে রথ আছে রাজপ্রাসাদ আছে। আর কী চাই বস?
'ম্যায় নে তো বস য়ুঁহি মজাক কিয়া।
নজরো সে দূর হটো রাম। 
আও গলে লগ জাও রাবণ।'

এখন তোর ছবি দেখলেই খুব হাসি। আর মনে মনে বলি- ইস মুরগিটা কেমন মানুষের মতো দেখতে! আর যখনই মাথা নাড়াস তখনই তুই গিরগিটি। মানুষ কোনভাবেই না। মুরগি বড়ো নির্লিপ্ত। আবার উঁচুদরের দার্শনিকও হতে পারে। বা ছাগশিশু। বলি হওয়ার আগেও সঙ্গমে আপত্তি থাকে না। 

মানুষ এতো নির্লিপ্ত হয় না।  কোনভাবেই না। তাই তো প্রতি মুহূর্তে চলতে থাকে ভোলবদল। রংবদলের খেলা।  ঠিক আরশোলার মতো। পঁয়ত্রিশ কোটি বছর ধরে টিকে আছে সে। তাও বহাল তবিয়তে।
এরকমই এক মানুষ- আরশোলার গল্প শুনিয়েছিলেন ফ্রাঁন্তজ কাফকা। জার্মান লেখক। তাঁর 'মেটামরফোসিস' গল্পে। সকালে ঘুম ভাঙতেই মানুষটি দেখেছিলো, সে আরশোলা হয়ে গেছে।
লন্ডনের উৎসাহী মানুষরা তো আরও এক পা এগিয়ে। আরশোলার চোখ দিয়ে টেমস দেখতে কেমন লাগে, তা জানতে ছোটেন সেখানকার সায়ন্স মিউজিয়ামে। ভোল বদলানোর স্বাদ চাখতে।

আর যে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাতে পারে না, সে ডাইনোসর। ধ্বংস হয়, তবু খাটো হয় না। রহস্যে ঢাকা থাকে তাদের মৃত্যুরহস্য। রেনকোজি মন্দিরে পড়ে থাকে চিতাভস্ম। তাসখন্দে সেদিন সত্যিই কী হয়েছিল? ডাক্তার সব জেনেশুনেও কেন ওই মারণ ইঞ্জেকশনটাই দিলেন? কোন স্পর্ধায় নিজের হাতে বিষপাত্র তুলে নেন তিনি?
সবই রহস্য। রং না বদলানোর আদিকাহিনী।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours