শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:
"রাজ্য
সুখের আশায় বৃথা কেউ বা কাটায় বছর মাস/স্বর্গ সুখের কল্পনাতে পরছে কারুর
দীর্ঘশ্বাস;/ নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকীর কাতায়,শুন্য থাক/ দূরের বাদ্য
লাভকি শুনে মাঝখানে যে বেজায়,ফাঁক। "
বলার অপেক্ষা
রাখে না, এ কবিতা বা রুবাইয়ের পাঠক বুঝে গেছেন এই অমর লেখার স্রষ্টা ওমার
খৈয়াম। খেয়ামের পুরো নাম; আবুল ফাত্তাহ গিয়াসউদ্দিন ওমর ইবনে ইব্রাহীম আল
খৈয়াম। পিতা ইব্রাহিম খৈয়াম।খৈয়াম অর্থ তাবু নির্মাতা।জাতিতে ওমর খৈয়াম
তুর্কী। তুর্কিমিনিস্তানের বাদখশান থেকে পূর্ব ইরানের খোড়াসানের নিশাপুরে
বসবাস করতেন। ওমার খৈয়াম একজন গণিতবীদ ও বিজ্ঞানী। তবে পৃথিবীব্যাপী কবি
হিসেবে তার বিশাল পরিচিতি। কবি হিসেবে ওমার খৈয়ামের মত পরিচিতি পৃথিবীর
কোন কবি পায়নি।
১০৯৮ সালে জন্ম নেয়া বিরল প্রতিভা
ওমার খৈয়ামের নাম শোনেননি পৃথিবীতে তেমন শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যাবে না। অথচ
এই মানুষটিকে পৃথিবী জানতে পেরেছে ১৮৫৯ সালে এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড
অনুবাদের মাধ্যমে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকেরা শতশত বছর শাসন করলেও। ওমর
খৈয়ামের রচনা নিয়ে কারো কোন আগ্রহ ছিলো না ফার্সী ভাষায় শাসকের ভাষা হওয়ার
পরও। সম্ভবত খৈয়ামের মুক্তচিন্তা মুসলিম স্কলারদের পছন্দ হয়নি। না হওয়াটাই
স্বাভাবিক। একদিকে তার মুক্তচিন্তা অন্য দিকে মুতাজিলাপন্থী ইবনে সীনা
ছিলেন তার শিক্ষক। এবং জন্মান্ধ আরবীয় কবি আবু আলা আল মাআররী দ্বারা ছিলেন
অনুপ্রানিত। মাআররী মুসলিম হয়েও ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনকে চ্যালেঞ্জ
করে কবিতা লিখে ছিলেন! যা আরো বিপদ জনক। তাই হয়তো জামী, রুমি, হাফিজ
চর্চা হলেও এ উপমহাদেশে ওমার খৈয়াম নিষিদ্ধ ছিলো। কেননা, তার কবিতায় মদ
নারীর দিকে ধাবিত করে। "মোল্লা" দের সমালোচনা তো রয়েছেই। খৃষ্টান ইংরেজদের
দ্বারা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর কোলকতায় ওমর খৈয়ামের কবিতা পাওয়া
যেতো আজকের পর্নোগ্রাফি চটি বইগুলোর মত!
ভন
হামার, নিকোলাস সহ অনেকেই ওমার খৈয়াম নিয়ে প্রথমে গবেষণা করলেও ১৮৫৯ সালে ৯
এপ্রিল ৭৫ টি রুবাই অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। যাতে অনুবাদক হিসেবে কারো
নাম লেখা ছিলো না। ১ শিলিং মূল্য ধরা হয়েছিলো। বই বিক্রি হয়নি। শেষে।এক
পেনি করে দোকান সেল।হিসেবে ছাড়া হয়! ১৮৬৮ সালে খৈয়াম গবেষক নিকোলাসের
ফরাসী অনুবাদ বের হলে, ফিট্সজেরাল্ডের উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনি ২য়,সংস্করণ বপর
করেন ৭৫ টির জায়গায় ১০১ টি রুবাইয়ের অনুবাদ নিয়ে। ইংল্যান্ডের কবি লেখক
সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সমর্থ হন। এবার মূল্য রাখা হয় সাত শিলিং দশ
পেনি। তবুও হট কেকের মত লাখ লাখ কপি বিক্রি হতে থাকে! আর সেই প্রথম
সংস্করণের যে কপি ১ পেনি রাখা হয়েছিলো তা নিলামে বিক্রি হয় আট হাজার
ডলারে! ওমার খৈয়মের নামে ইউরোপে ক্লাব খোলার ধূম পরে। সারা পৃথিবীতে তার
কবিতার অনুবাদ বের হতে থাকে বিভিন্ন ভাষায়, সকল দেশে।
১৯১৯
সালে কান্তিদাস ঘোষ ফিট্সজেরাল্ডের ৭৫ টি রুবাইয়াতের অনুবাদ করেন। তবে,
ফিট্সজেরাল্ডের আগেও বাংলায় ওমার খৈয়ামের অনুবাদ পাওয়া যায় রঙ্গ লাল সপনের
অনুবাদে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯১৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ওমর খৈয়াম
ও তার কবিতা নিয়ে এক প্রকার উম্মাদনা ছিলো। কান্তি চন্দ্র দাস, নরেন
দেব, সিকান্দার আবুনজাফর,ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, নজরুল ইসলাম, সৈয়দ
মুজতবা আলী, রবীন্দ্রনাথ কে কে মুগ্ধ হননি ওমর খৈয়াম ও তার কবিতায়!
খৈয়ামের কিছ কবিতা ;
শুক্রবার
আজ,বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার /হাত যেন ভাই খালি না যায়,শরাব চলুক আজ
দেদার /এক পেয়ালি শরাব যদি পান করো ভাই অন্য দিন /দু পেয়ালি পান করো আজ
বারের বাদশা জুম্মাবার।"
" মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু প্রায়/ ওগো প্রভু, কোন মাটিতে করলে সৃজন এ আমায়?"
"কারো প্রাণে দুঃখ দিও না করো বরং হাজার পাপ/ পরের মনের শান্তি নাশি বাড়িও না তার মনস্তাপ। "
"ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন শাস্ত্র পাঠ/ তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বেণীর ঠাঁট।"
"
ওগো সাকি! তত্ত্বকথা চার ও পাঁচের তর্ক থাক,/উত্তর ঐ সমস্যার গো এক হোক কি
একশো লাখ/আামরা মাটির, সত্য ইহাই,বেণু আনো,শোনাও সুর!/ আমরা হাওয়া, শরাব
আনো! বাকি সব চুলোয় যাক।"
"খারাব হাওয়ার শরাব -খানায় ছুটিছি আমি আবার আজ,/ রোজ পাঁচবার আজান শুনি,পরতে নাহি যাই নামাজ!/"
"ভাগ্যদেবী!
তোমার যত লীলাখেলায় সুপ্রকাশ /অত্যাচারী উৎপীড়কের দাসী তুমি বারো
মাস/মন্দকে দাও লাখ নিয়ামত ভালোকে দাও দুঃখ -শোক/বাহাত্তুরে ধরলো শেষে? না এ
বুদ্ধিভ্রম বিলাস?"
"স্রষ্টা
মোরে করলো সৃজন জাহান্নামে জ্বলতে সে/কিংবা স্বর্গে করবে চালান - তাই বা
বলতে পারে কে!/করবো না ত্যাগ সেই লোভে এই শরাব সাকি দিলরুবা /নগদার এ
ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?"
ভারতের
লক্ষনৌও, কোলকাতা আলিয়া মাদরাসায়, তপহরান ও অক্সফোর্ডে ওমর খৈয়ামের মূল
লেখা ও ও মূল লেখার অনুলিপি আজো সংগৃহিত রয়েছে। সম্ভবত রুবাইয়াত ই ওমর
খৈয়ামের কাব্যই এক মাত্র কাব্য যা বারবার পড়লেও পাঠক বিরক্ত হয় না। কবিতা
লেখা ও মুক্তচিন্তা চর্চার কারনে তাকে তার শহর ছাড়তে হয়েছিলো। তিনি ও তার
লেখা বহুদিন নিষিদ্ধ ছিলো।
শেষে ফার্সী একটি রুবাই দিয়েই লেখার ইতি টানছি। যে রুবাইয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন কেন শরাব নিষিদ্ধ করা হলো?
★"
এই মানেয়ে বার মুস্তাফাই বেসানিদ সালাম/ব' আকায়ে বেকুয়িদ যে বাই খাম
তাসাম/ কেয় সায়িদে হাশেমি চেরা দাও রে তোবাশ /দার শলা হালালস্ত ব' দার
শরাবে হারাম।" ((মূল ফারসী রুবাইয়ের বাংলা উচ্চারন ও অনুবাদ)
★
" পৌঁছে দিও হজরতেরে খৈয়ামের হাজার সালাম, /শ্রদ্ধাভরে জিজ্ঞাসিও তারে
লয়ে আমার নাম-/বাদশা নবী; কাজি খেতে নাইতো নিষেধ শরীয়তে /কি দোষ করলো
আঙ্গুর পানি? করলে কেন তায় হারাম?"
কোলকাতাতেও এক
সময় ওমর খৈয়াামকে নিয়ে নাটক হতো। ওমর খৈয়ামের কবিতা ও দর্শন চর্চার পরিধি
বাড়লে এ উপমহাদেশে মৌলবাদের ভিত্তি নরবরে হয়ে যেতো। যা আজ খুব জরুরি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours