কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
দিদিভাই মোদিভাই।
দিদি উড়ে গেলেন দিল্লিতে। মঙ্গলবার দুপুরে। আগামিকাল বিকেলে দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। যাওয়ার আগে জানিয়ে গেলেন, রুটিন দিল্লি সফর।
ওদিকে রাজীব কুমারের আইনজীবী পৌঁছলেন বারাসত আদালতে। আর্জি, আগাম জামিন দিন ধর্মাবতার। সিবিআই বিশেষ আদালত রাজি হলো না আর্জি শুনতে। বিচারক সঞ্জীব দারুকা জানিয়ে দিলেন, আর্জির আবেদন শোনার এক্তিয়ার নেই। অগত্যা, দ্বারস্থ জেলা দায়রা আদালতের।
চৌত্রিশ নাম্বার পার্ক স্ট্রিটেই কি গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছেন রাজ্য গোয়েন্দার এডিজি রাজীব কুমার? এই প্রশ্নের এখনও কোনও সদুত্তর মেলেনি। পুলিশ প্রশাসনিক মহলে তাঁর নামডাক সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়েই সিবিআইয়ের চোখে ধুলো দিয়েছেন বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারনা। এমনকি তিনি আত্মগোপন করেই ভিডিও কনফারেন্স করে চলেছেন আইনজীবীদের সঙ্গে। গত শুক্রবার থেকেই অবিরত খুঁজে চলেছেন রাস্তা- কিভাবে সিবিআইয়ের গ্রেপ্তারি এড়ানো যায়।
ওদিকে সিবিআইকর্তারাও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজীব কুমারকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো দ্বিতীয় নোটিশটিও উপেক্ষা করলেন তিনি। আজই মেয়াদ শেষ হলো সেই নোটিশের।
সোমবার ধোঁয়াশা তৈরি হয় বারাসত সিবিআই বিশেষ আদালতে রাজীব কুমারের আগাম জামিনের আবেদন জানানো নিয়ে। কারণ গতকাল এক আইনজীবীর প্রয়ানের ঘটনায়, আইনজীবীরা কর্মবিরতিতে যান বলে খবর। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের খবরে আদালতের সরকারি আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, সম্ভবত এরকম কোনও আবেদন জমা পড়েনি। তবে মঙ্গলবার সকালেই ধোঁয়াশা কাটলো। সেই সঙ্গে আরও একবার ধাক্কা খেলেন রাজীব কুমার। শুনানির জন্য গৃহীতই হলো না আগাম জামিনের আর্জি।
ওদিকে গোটা ঘটনাকে পাত্তা দিতে নারাজ সিবিআই। তবে মঙ্গলবার সকালেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের প্রতিনিধিরা বারাসতের বিশেষ সিবিআই আদালতে পৌঁছে যান। সংস্থার তরফ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে, রাজীব কুমারের জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানি জারির অনুমতি চেয়ে। দুপক্ষের আইনজীবীর প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সওয়াল জবাব শোনেন বিচারক। কিন্তু ওই পরোয়ানা জারির এক্তিয়ার আদৌ তাঁর আদালতের আছে কিনা তা নিয়ে নিজেই প্রশ্ন ওঠান। এরপর আদালতের রায়দান স্থগিত রাখা হয়।
ওদিকে সিবিআই বিশেষ আদালতে আর্জি গৃহীত না হওয়ার পর বারাসত জেলা দায়রা আদালতের দ্বারস্থ হন রাজীব কুমারের আইনজীবী। তাঁর মক্কেলের আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা দু'পক্ষের সওয়াল জবাব শোনেন বিচারক।
রাজীব কুমারের আইনজীবীর মূল বক্তব্য ছিলো, এর আগেই তাঁর মক্কেলকে চল্লিশ ঘণ্টা ধরে শিলঙে জেরা করেছে সিবিআই। ওদিকে সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়, সারদাকর্তা সুদীপ্ত, দেবযানী সেনের থেকে বাজেয়াপ্ত করা ছটি মোবাইলের কল লিস্টে বিকৃতি ঘটান রাজীব কুমার। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের আড়াল করা। রাজীব কুমারের আগাম জামিনের কড়া বিরোধিতা করে সিবিআই জানায়, অভিযুক্তকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত জেলা দায়রা জজ জানান, মূল মামলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অধীনে। সুতরাং এই আবেদন শুনানির উপযুক্ত জায়গা এই আদালত নয়। স্বাভাবিকভাবেই তা ফেরত গেল সেই আলিপুর আদালতেই। এক কথায়, রাজীব কুমারের অবস্থান একচুলও এগলো না। দিনের শুরুতে তিনি যেখানে ছিলেন, দিনের শেষেও সেখানেই থাকলেন। আগাম জামিনের আর্জি ফেরাল বারাসত আদালত।
রাজীব কুমার, সিবিআইয়ের আইন আদালতের এই লুকোচুরি খেলার নেপথ্যে শুরুর থেকেই রাজনীতির গন্ধ পেয়েছিলেন রাজনীতিবিদরা। প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ জানিয়ে আসছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ওদিকে বিরোধী শিবিরের দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর আশ্রয়েই আছেন অভিযুক্ত রাজীব কুমার। তবে এ মুহূর্তে রাজীব কুমার ঠিক কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ নবান্নের। সিবিআইয়ের লেখা চিঠির জবাবে নবান্নর তরফে জানানো হয়, সিআইডি এআইজি রাজীব কুমার ছুটিতে আছেন। কলকাতাতেই আছেন তিনি। তবে এআইজি'র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা জানানো হয়নি। অভিজ্ঞ মহলের মত, রাজীব কুমারের খোঁজ পেতে নবান্নের কোর্টে বল ঠেলে দিল সিবিআই।
রাজীব কুমারকে বাঁচাতে এবার মোদির শরণে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটাই মন্তব্য কংগ্রেস সিপিএমের। "তবে নরেন্দ্র মোদিকে ধরেও লাভ হবে না," বলেন দিলীপ ঘোষ। তিনি জানান, পিসি ভাইপো আর বাঁচবেন না।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে দিল্লি যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, "রুটিন কাজে যেতেই হয়। কলকাতাতেই তো তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই থাকি।" এবার মোদির সঙ্গে রাজ্যের বকেয়া টাকা পাওয়ার কথা বলবেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে আলোচনা হবে রাজ্যের উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা নিয়ে। প্রসঙ্গ উঠবে রাজ্যের নামবদলের ঝুলে থাকা প্রস্তাব নিয়েও। কাল, বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাত মোদির সঙ্গে।
তবে কথা উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লিযাত্রার সময় আর প্রেক্ষিত নিয়ে। এ ব্যাপারে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি'র গলায় এক সুর- বাংলার উন্নয়ন নিয়ে হঠাত এত ব্যস্ত কেন হয়ে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী!
প্রসঙ্গত, গত বছর মে মাসের পঁচিশ তারিখে, বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে শেষবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখী হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর একাধিক বার দিল্লির আমন্ত্রণে সাড়া দেননি তিনি। এমনকি কয়েকবার রাজ্যের তরফ থেকে কোনও প্রতিনিধিও পাঠানো হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ ষোল মাস পর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিযাত্রা নিয়ে কটাক্ষ করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি বিরোধী শিবির।
মঙ্গলবার দিনভর চেষ্টা চালিয়েও আগাম জামিনের রক্ষাকবচ অধরাই থাকলো রাজীব কুমারের। এবার অপেক্ষা সিবিআই কোন পথে এগোয় তা দেখার জন্য।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours