জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:
রেনেশাঁয় হাতে হাত মিলিয়ে, যদি মানা যায় অষ্টাবিংশ শতাব্দী শুরু পর্য্যন্ত, যেভাবে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে গনতান্ত্রিক বিপ্লব এগুচ্ছিলো, সেই তাল মিল যদি বিদ্যমান থাকতো, তবে দর্শনের ইতিহাসে কার্ল মার্ক্সের আবির্ভাবই ঘটতো না।
বুর্জোয়ারা বিজ্ঞানর সত্যকে গোপন করতেই 'অবতারতত্বের' আমদানি করতো। সামন্তিকরা তো ইতিহাসের অভিমুখে চিন্তার পরগাছা স্থাপন করতে তো, রাজা এবং পুরোহীতদেরকেই অবতার বানিয়ে বসলো। সে পূরোহীত ব্রহ্মন হোন কিংবা পাদ্রি অথবা মৌলবী হোন না কেন, এ কাজটা চলেছে পুরোদমে, তবে ইতিহাসের সাথে সঙ্গতি রেখে সেখানেও রুপান্তর ঘটেছে।
যে বুর্জোয়ারা একদিন প্রজাতন্ত্রকে অবতারবাদকে ভাংগতে ভাংতেই বিজ্ঞাননের শাসনকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই পূঁজির একচেটে যুগ আসার পর থেকে, টিকে থাকা অবতারবাদকে আশ্রয় করেই, বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে 'গতির তৃ্তীয় ধাপে' আকে দিয়ে, রেনেশারঁ বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষনা করলেন। এবারে আর 'সৃজনী' কিংবা প্রজাতন্ত্রের উপর 'দেবত্ব' আরোপ নয়, আরোপিত হোতে লাগলো, সেই যায়গাটাতেই, যার আবিস্কার বিজ্ঞানের 'তিনগতি' আবিস্কারের পর অনাবিস্কৃত রেখে দেওয়া হোল এবং পরে মার্ক্স সেখানে পৌছে তিনি দর্শনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে যাওয়ার সুযোগ করে নিয়েছিলেন।
এই জায়গাটিই কেউ 'আত্মা' বলে চেনেন, আমরা সমাজবিজ্ঞাননের ছাত্ররা একে 'মন হিসেবে' আবিস্কৃত শিখেই ,কার্ল মার্ক্সের হাত ধরে ইতিহাসের নিয়ামক হিসেবে চিনেছি।
সেই সুত্রেই বুঝেছি, বিশ্ব রুপান্তরের সব প্রহেলিকা নিরশনে যারা
--- , 'মন'কে একপ্রান্তে শ্রমেরই এবং সেই সুত্রে বস্তুজগতের সর্বোচ্চ বিকশিত' রুপ রুপে, ইতিহাসের গতির ধারক এবং
------ অন্যপ্রান্তে, বোধজগতের সর্বকতৃত্বরুপি অবতার কিংবা 'পরমাত্মা' হিসেবে দেখার দ্বন্দ্বে আবর্তীত বলে দেখতে অস্বিকার করেছেন, তারা যে শুধু ইতিহাস বোধেই নয়, বোধগগতের অন্ধকারাগারে এক চিরন্তন বন্দিদশায় নিজেকে আবদ্ধ রাখবেন। বিশ্ব রুপান্তরের পথে ব্যতিরেখে মুক্তি নাই।
সেই চর্তুদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্য্যন্ত, রেনেঁশা এবং পুজি যতদিন আলিংনাবদ্ধ ছিলো, মানুষের জ্ঞান এবং সংস্কৃতি জগতকে সুত্রবদ্ধ করে, আন্ধকার ভেদ করেই এই যুগলবন্দি এগিয়ে চলছিলো। মানব সভ্যতাও নিজেকে আলোকিত এবং সমৃদ্ধ করার সুযোগ করে নিচ্ছিলো। কিন্তু
-----ভোরের সূর্য্য উঠবো উঠবো সময়েই উল্লেখিত যুগলবন্দি থমকে দাড়ালো। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই, সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির নিরশনে পুজিতন্ত্রের অক্ষমতা যেমনভাবে প্রকট হয়েছে, তেমন ভাবে রেনেশাঁর গতি আলগা হতে হতেই একটা সময়ে থেমে গেলো পুজিতান্ত্রিক অসহযোগীতারই কারনে।
সেসময় মনুষ্য-চিন্তন, প্রকৃ্তি বিজ্ঞানে অজৈব জৈবের সীমানা ছাড়িয়ে সবে মনের অবচেতন অংশ, যাকে ফ্রয়েডীয় তত্ব বলে পছন্দ করা যেতে পারে, বিস্তৃত হয়েছে মাত্র। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান কিন্তু সমাজবিজ্ঞান বা মন সংক্রান্ত বিজ্ঞানে প্রবেশের সুযোগ করে নিয়েছে। মার্কেসের পূর্বজ হিসেবে, দু' জন দু'দিক থেকে 'বস্তু হিসেবে মন' এবং দ্বন্দ্বতত্বের প্রাথমিক দিক - এই দুটি দিক ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। এদের নাম 'রবার্ট ওয়েন' এবং 'ফায়ারবাক'। ইতিমধ্যে, মার্ক্সের গুরু হেগেলের যুক্তিবাদ, বস্তুজগত নির্মানে দ্বান্দ্বিক ভূমিকা সম্পর্কে একটা সাধারন ধারনার কথা বলে দিলেও, অবতারবাদ কিংবা দেবত্বের প্রতি আনুগত্য থেকে দূরে সরে আসতে পারলেন না।
---- কার্লমার্ক্স অতীতের সব ধারনাকে একসুত্রে বেঁধে প্রথমে বস্তু জগতের সর্বোচ্চ রুপ হিসেবে 'মন'কে আবিস্কার করলেন 'শ্রম' নামক বস্তুটির সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে এবং সেটিকেই সামাজিক বা ইতিহাসের গতি বা বস্তুজগতের চতুর্থ বা শেষ গতি হিসেবে আবিস্কার করলেন।
---- সে সব বুদ্ধিজীবিরা যারা মার্ক্সবাদের আলোকে মার্ক্সের আবিস্কারগুলিকে না দেখে, সাধারন বুর্জোয়া জ্ঞানের আলোকে দেখার চেষ্টা করেছেন তারা সাধারনভাবে, মার্ক্সীয় অর্থনীতিকে বা পুঁজির তিন ভ্যলুমকে বুনিয়াদী মার্ক্সবাদ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।সে বিচারে যদিও তখনো প্রমানিত নয়, তবু ১৯৪৮ শে লেখা ' কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোকে অনেক বুনিয়াদী বিচার করতে হবে।
----- মার্ক্সবাদ বিশ্বে সর্বাকালের দর্শন হিসেবে আবিস্কৃত হয়ে যাওয়ার পর, মার্ক্সবাদ সমেত ইতিহাসের সব দর্শনের ধারাই মার্ক্সবাদ নিরপেক্ষ স্বাধীন দর্শন হিসেবে পরিচিতির স্বাধীনতা হারিয়েছে।
আসলে ম্যানিফেষ্টো সমেত মার্ক্সের সব কাজই, শেষ পর্য্যন্ত জ্ঞান সাগরের যে অখন্ড সত্বায় এসে মিশেছে তাই মার্ক্সের 'জ্ঞান তত্ব' হিসেবে স্বিকৃ্তি পেয়েছে। এই তত্বই দর্শনের শেষ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। প্রশ্নটি এখানেই, চিন্তা যদি মনের ক্রীয়া বলে বিবেচিত হয় এবং যদি একাধারে শ্রমেরই ক্রম বিকশিত ধারা বা সৃজন এবং সৃজনীর প্রতিবিম্ব বলে বিবেচিত হয়, তবে সে কবে এবং কীভাবে মুক্ত বিহংগ হতে পারবে।
------ সেখানে তিনি সৃজনীকে জ্ঞানের উৎস মুখ হিসেবে দেখেছেন, তেমনি জ্ঞানকেই, বিশ্বমাঝে নিজের অস্তিত্ব চিহ্নিত করা এবং পূনঃসৃজনের মধ্যে দিয়ে, বিশ্বসৃজনে জ্ঞানের উন্মুক্তির বিষয়গুলিকে
------- একই সুত্রে 'মন' এবং ইতিহাসের বিকাশের স্তরগুলির সাথে একাত্ম করেছেন। এই গ্রহন, সংশ্লেষন এবং ফিরিয়ে দেওয়ার সবগুলি ধাপের মুল্যায়ন এবং বিশ্লেষনের কারনেই জ্ঞান তত্বের অন্য শাখা
------ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে আবিস্কার করেছেন।
তিনি বুঝিয়েছেন, মনুষ্য সৃজনী এবং মনের সাবলিল গতির অভিমুখের অধিকাংশটাই ইতিহাসের অতি-অতীতের পুঁজরক্তে এমনভাবে চাপা পরে আছে, সেখানে
----- কালান্তরের পথে 'চিত্তের অন্ধকার প্রকোষ্টগুলিকে আলোকিত করবে ঠিক, কিন্তু প্রকৃ্ত অর্থে 'মনের সৃজনরুপ' পাখা মেলার সুযোগ পাবে সাম্যের পরেই।
একেবারে সমধর্মী না হলেও রবীন্দ্র ভাবনার মূল দিকটিও যে এই 'চিত্ত মুক্তির' প্রশ্নের সাথে যুক্ত ছিলো সে কথা সবাই মেনেছেন। তিনি 'নির্ঝরের স্বপ্ন ভংগে 'চিত্ত যে এক অন্ধ কারাগারে বন্দী তার বর্নন করেছেন ছন্দে ছন্দে ছন্দে। অন্য একটি কবিতায় একই কথা অন্যভাবে লিখছেনঃ
" শুনেছি আমারে ভালোই লাগে না, নাই বা লাগিল তোর !
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লোহার শিকল ডোর।
তুই তো আমার বন্দী অভাগী, বাধিয়েছি কারাগারে,
প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে।"
অনেক সময়, রাগ কিংবা অভিমান অথবা দুঃখ নয় নিজেদের মুর্খামীকে দায়ী করি। আমরা ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা ট্রেড ইউনিয়ন বিদ্যালয়ে সব কিছু শিখানোর চেষ্টা করেছি। কিন্ত কধ্যাপী বোঝার চেষ্টা করেছিঃ
------ দ্বন্দ্বতত্ব সমেত জ্ঞানতত্ব এবং জ্ঞানতত্বের আলোকে কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্টোকে না বুঝতে শিখিয়ে, আমরা অন্য সব শিক্ষাকে আবর্জনায় যায়গা করে দিয়েছি।
শিরোনাময় ফিরে এসেই লেখাটা শেষ করা যাক এই প্রতিশ্রুতী রেখে
------ আগামী সংখাটি এই শিরোনামাটি ধরেই শুরু করা যাবে। মার্ক্সবাদ
জ্ঞানতত্বে, মনের সৃজনী রুপটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে,জ্ঞানের বাঁধুনীটি শক্ত, প্রাঞ্জল এবং পবিত্র হলেই,
একজন বিশ্বজগতে চেনা এবং সেখান থেকে গ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করবে।
কাজেই 'রিসিভিং' দিক শক্তিশালী হলেই বিষয়কে 'পারসিভ করা ' সম্ভব । গতকালের লেখার সুত্র ধরেই বলে রাখি, বুঝে নেওয়ার অর্থই 'পারসিভ' অনুধাবনের তলানীতে গিয়েই পারসিভ করা সম্ভব এবং সেটি ঘটলেই পূনঃ নির্মানে সৃজনের সংশ্লেষন সম্ভব। (ক্রমশ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours