কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
ক্যামেরা রোলিং।
এলগিন রোডে এক বহুতলের গেটে পৌঁছতেই শুরু হলো ভিডিওগ্রাফি। তটস্থ মানুষজন। কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না ব্যাপারটা কী। গাড়ি থেকে একে-এক নেমে এলেন সিবিআই অফিসাররা। মোট দশজন। আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। সেই ব্যক্তিটির নাম সৈয়দ মহম্মদ হসান মির্জা। এক দুঁদে আইপিএস অফিসার।
রবিবার। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটার পাশে ঘোরাঘুরি করছে। ছুটির দিন বলে রাস্তায় ভিড়ভাড় কম।মির্জাই সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁকে ঘিরে সশস্ত্র প্রহরীর দল। ব্যস্ত ভিডিও ফটোগ্রাফার। প্রতিটা মুহূর্তের ছবি তুলে চলেছেন। ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখছেন গাইড মির্জা কিভাবে দশ সিবিআই আধিকারিককে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। এবার সিবিআই অফিসাররা এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। মির্জা আপত্তি করলেন। না, তিনি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠেননি। লিফটে গেছিলেন। সবকিছু ধরে রাখল ক্যামেরা।
লিফটে চড়ে সোজা থার্ড ফ্লোরে। নির্ভুল ভাবে এগিয়ে গেলেন এক দরজার দিকে। বোঝা গেল, ওই ফ্ল্যাটে এর আগেও এসেছেন মির্জা। শনিবার সিবিআই কর্তাদের কাছে এমনটাই দাবি করেছিলেন তিনি। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই মির্জাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন সিবিআই অফিসাররা। ফ্ল্যাটের ভেতর তাঁদের জন্য তখন অপেক্ষা করছিলেন মুকুল রায়। প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ, বর্তমানে বাংলায় বিজেপি'র মুকুটহীন সম্রাট এই পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ।
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেই নিজাম প্যালেসে, মুকুল রায় মির্জাকে পাশাপাশি বসিয়ে জেরা করেছিল সিবিআই। বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিস সুপার মির্জার দাবি, তিনি যা কিছুই করেছেন সবই তৎকালীন বর্ধমান জেলার দায়িত্ব থাকা তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের নির্দেশে। সিবিআইয়ের প্রশ্ন, তাহলে কি ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনে মির্জাকে যে মোটা টাকা নেওয়ার দৃশ্যে দেখা যায়, তার পেছনেও কি মুকুলের নির্দেশ কাজ করেছিল? ফোনে তিনি এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন। সেই ঠিক জায়গাটা কোথায়? কার সঙ্গেই বা ফোনে কথা বলেছিলেন মির্জা?
ওদিকে মুকুল সাফ কথায় বলেন, "নারদকাণ্ডের কোনও ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িয়ে নেই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।"
মির্জার গতকালের বয়ানের সূত্র ধরেই রবিবার, অতীতের সেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে সিবিআই। উদ্দেশ্য, মির্জার কথা যাঁচাই করে নেওয়া। ঠিক কোন রাস্তা ধরে মির্জা ওই বহুতলে আসতেন? গাড়ি কোথায় রাখতেন? প্রতিটা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খের সাক্ষী থাকলো ভিডিওগ্রাফি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মির্জা বললেন, "রিকনস্ট্রাকশন অফ ক্রাইমের জন্য আনা হয়েছে।" এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি। বলেন, "সিবিআই আইও'র সঙ্গে কথা বলুন।" নিরাপত্তারক্ষীরা কড়া নজর রেখে চলেছিলেন সাংবাদিকরা যাতে মির্জার খুব কাছে ঘেঁষতে না পারেন।
মুখ খোলে সিবিআই। "মুকুল রায়ের অনুমতি পাওয়ার পরেই এই কাজে নেমেছি।" টাকার অঙ্ক নির্দিষ্ট করে কিছু না বললেও জানানো হয়, এখানেই 'হিউজ মানি'র লেনদেন হয়েছিল। ফ্ল্যাটের ভেতরে ঠিক কোথায় বসেছিলেন মির্জা। কোথায় বসেছিলেন মুকুল। মির্জার বয়ান মতো, প্রতিটা ঘটনার দৃশ্য এদিন ক্যামেরাবন্দি করা হয় বলে সূত্রের খবর।
পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই তাঁদের যাবতীয় কাজ সেরে ফেলেন সিবিআই আধিকারিকরা। এরপরেই বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ তাঁরা মির্জাকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে বিদায় নেন। ওদিকে আজও
সাংবাদিকদের সামনে ফের বিস্কোরক তথ্য দিয়ে মুকুল রায় বলেন, "আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর এই গোটা চক্রান্তের পিছনে আছেন মুখ্যমন্ত্রী।" তাঁর অভিযোগ, নারদকাণ্ডে সিবিআইয়ের জালে যে জড়িয়ে পড়ছে তাকেই শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'মুকুলের' নাম করতে। উদ্দেশ্য একটাই মুকুল রায় আর বিজেপিকে হেয় করা।
মির্জাকে নিয়ে সিবিআইয়ের তাঁর এলগিন রোডের ফ্ল্যাটে আসা নিয়ে মুকুল জানান, মির্জার দাবি তিনি এই ফ্ল্যাটেই ম্যাথুকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে ওই ফ্ল্যাটে কোনরকম টাকা-পয়সার লেনদেন হওয়ার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন মুকুল রায়।
এদিকে আগামিকাল, সোমবারই শেষ হবে মির্জার পাঁচদিনের হেপাজত। তাঁকে আদালতে তোলা হলে হেফাজতের মেয়াদ বাড়ানো হবে কিনা তা হলপ করে বলার কোনও উপায় নেই। তাই একটি মুহূর্তও অপচয় করতে নারাজ সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দারা চাইছেন, যত চটপট তদন্তের কাজ এগিয়ে রাখা যায়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours