শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:
শ্রাবণ
মাস শেষ হলে অনেকেই স্বস্তি পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, বেশ কিছুদিন
শব্দ-দানবের তান্ডব ভুগতে হবে না। কিন্তু সে আশায় ছাই দিয়ে, মাত্র কয়েকটা
দিন যেতে না যেতেই আবার শব্দদানব তান্ডব শুরু করে দিল। জন্মাষ্টমী শেষে
এবারের উপলক্ষ্য শনি মহারাজের পুজো। সঙ্গে যোগ হয়েছে মহরমের বাজনা। আর
প্রতিদিন নিয়ম করে দিনে বেশ কয়েকবার মাইকে বাজানো নির্দিষ্ট কোনো উচ্চারণ
তো রয়েইছে। এখনও সামনে আছে বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু করে শারদীয়া
দুর্গাপূজা, কালীপূজা ইত্যাদি। অর্থাৎ বাঙালির মূল উৎসবের প্রায় সব ক`টিই!
শ্রাবণ মাস থেকে শুরু করে এখনো অবধি যে নমুনা পাওয়া গেল, তাতে
আগামীদিনগুলিতে কী যে হতে চলেছে সেটা ভেবে শিউরে উঠতে হচ্ছে।
সত্যি
বলতে ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে এরকম উদ্দীপনা এবং উৎসাহ কোনোদিন চোখে পড়ে নি।
পুরোনো দিন তো বটেই, বছর ছয়-সাতেক আগেও এই জাতীয় উদযাপন লক্ষ্য করা যেত না,
যা বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে।
কারো ধর্মচারণ নিয়ে
কোনো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়, কেননা ব্যক্তিগত পরিসরে কে কী করবেন তা একান্তই
তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু তা পালন করতে গিয়ে যদি অন্যের অসুবিধে হয়, তবে
নিশ্চয়ই কিছু বলার থাকে। আফসোস এটাই যে, শব্দদূষণের এই ঘটনাকে বিশেষ
কোনো দিনে যেমন সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না, তেমনি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয়
সম্প্রদায়কেও দায়ী করা যাচ্ছে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে সকলেই দিনের পর দিন
যেভাবে শব্দ দূষণ করে আসছে তাতে ভাবার সময় হয়েছে।
আসলে
আমরা একটা অদ্ভুত সময়ে বাস করছি। একদিকে ভারত মহাকাশে চন্দ্রযান পাঠাচ্ছে,
অন্যদিকে কিছু রাষ্ট্রনেতা গোমূত্র থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে, পারদর্শিতার
সঙ্গে, এমন কিছু কথা বলছেন যাতে স্তম্ভিত হতে হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের
বিষয় এটিই যে, বহু সংখ্যক মানুষ এসবে বিশ্বাস করেন বলেই দিনের পর দিন ধর্ম
নামক বস্তুটি নানা ভাবে, নানা রূপে, নানা কায়দায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বর্মের
মতো আমাদের ওপর চেপে বসছে। পরিসংখ্যান বলছে যে, বিগত এক দশকে দেশে পূজা বা
উপাসনার জন্য যত সংখ্যক ছোট-বড় মন্দির-মসজিদ তৈরী হয়েছে
তা
অন্য দশকগুলির তুলনায় অন্তত পাঁচগুণ বেশি। আমরা ধর্মকে যতটা বড় করে
দেখছি, অন্য কোনো কিছুকে ততটা নয়। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিপূর্ণ ভাবনার স্থান
নিচ্ছে কুসংস্কারে ভরা এমন সব আচার ব্যবহার, যা এই একবিংশ শতকে এসে কেউ
করতে পারে বলে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ঠিক সেটাই হচ্ছে। এই ব্যাপারে কেউ
পিছিয়ে নেই। এক্ষেত্রে আমাদের মগজধোলাই এমন পর্যায়ে করা হচ্ছে যে, দারিদ্র,
বেকারত্ব, অপুষ্টি, অশিক্ষার মতো বিষয়গুলির দিকে কেউ আর ফিরে তাকাচ্ছে না।
ইতিমধ্যেই যে ভারতের অর্থনীতি খাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার খবর কতজন
রাখছে? একের পর এক শিল্প বন্ধ হচ্ছে তা যেন আমরা দেখেও দেখছি না।
বেসরকারিকরণের যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে আগামীদিনে সরকারের হাতে
যে কিছুই থাকবে না সেটা কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর এসবের থেকে চোখ
ঘোরাতে ধর্মের তাসকে সুনিপুনভাবে ফেলা হচ্ছে। এই ব্যাপারে বাম-ডান সকলেই
এক। প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে আশু সমস্যা থেকে অন্যদিকে নজর ফেরাতে ধর্মের
জুড়ি মেলা ভার। আর ধর্ম পালনের সঙ্গী হয়েছে পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত
ক্ষতিকারক এমন কিছু আচার আচরণ যাতে প্রতিনিয়ত পরিবেশের দফারফা হচ্ছে।
প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হয় না। প্রতিবাদের সাহসটুকুও অনেকের থাকে না। কেননা
ধর্মোন্মাদ জনতার যে কী হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তা আমাদের দেশের মানুষ খুব
ভাল জানেন। তাই পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবে সত্যি খারাপ লাগে যে, আমরা
তাদের জন্য এমন এক দেশ রেখে যাচ্ছি যেখানে মেধা দাম পায় না, কদর হয় পাথরের
বা শূন্য উপাসনালয়ের।
এই অবস্থা থেকে ঠিক কবে
পরিত্রাণ মিলবে তা কেউ জানে না। দেশের সব মানুষই যে এরকম তাও নয়। দেশের
কোনো উন্নতি হয় নি এটা বলেও অন্যায় হবে। অনেক বিষয়ে এমন কাজ হয়েছে বা
হচ্ছে, যা আমাদের সত্যি গর্বিত করে। কিন্তু পাশাপাশি যখন কিছু তমসাচ্ছন্ন
অধ্যায় দেখি তখন ঠিক মেলাতে পারি না। এই বৈপরীত্য আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য
হলেও কোনোদিন সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি হতে দেখি নি। কিন্তু এখন ভয়টা এখানে যে,
সেই বাড়াবাড়িটা দিনদিন প্রবল আকার ধারণ করছে। এই প্রাবল্য যদি তা না
থামানো যায় তবে ভবিষ্যতে আমাদেরকেই ভুগতে হবে। আধুনিক কল্যাণকর কোনো
রাষ্ট্র যেমন এইভাবে চলতে পারে না, একজন ব্যক্তি মানুষও এভাবে চলতে পারেন
না। এই দুরাবস্থা থেকে মুক্তির কোনো উপায় অন্তত এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে
না। ফলে অনভিপ্রেত ব্যাপারগুলি প্রবলভাবে জেঁকে বসছে। এই ব্যাপারে মিডিয়ার,
বিশেষ করে টেলিভিশনের, ভূমিকাও কিন্তু কম নেই। জাতীয় স্তরের বেশ কিছু
চ্যানেল এমন সব সিরিয়াল সম্প্রসারণ করেন যেখানে কুসংস্কারে মোড়া এই জাতীয়
বিষয় দেখানো হয়। দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষের কাছে এই সিরিয়ালগুলো বড়
মাপের বিনোদন। এদের প্রভাবও বিরাট। যুক্তিবাদী চিন্তার পরিবর্তে যদি তারা
এই সব বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দেয় তবে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মাঝে
মাঝে জানতে ইচ্ছে করে যে, নির্মাতারা নিজেরা এসব আবিষ্কার করেন, নাকি
বাজারে কী চলছে সেটা দেখে তাদের নির্মাণ প্রস্তুতি নেন।
আমাদের
সকলের মনে রাখা উচিত যে, কোনো বিষয়েই অত্যাধিক কিছু করা শেষ পর্যন্ত
নিজেদের ক্ষতি করে। তাই নির্দিষ্ট সীমার মাঝে থেকে থেকে চলুক সব। তাতে
অন্তত অভিযোগের তীরটি কেউ ছুঁড়বে না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours