গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

অবিভক্ত বাংলায় দুর্গাপূজার সূচনা ঠিক কবে হয়েছিল এ নিয়ে অনেক মতান্তর এবং বিভিন্ন গবেষকদের বিভিন্ন মতবাদ আছে। তবে বহু প্রাচীনকাল থেকেই যে এই অবিভক্ত বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল তার অনেক প্রামাণ্য ইতিহাস আর প্রচলিত গল্প আছে। মনে করা হয় যে ষোড়শ শতকে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার দেওয়ান হন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন্তরাজা কংস নারায়ণ, এতো বড় একটা পদ পাওয়ার পর, আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজা পৌরণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন,তখন তার রাজ-পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী কংস নারায়ণকে জানান যে, শাস্ত্রীয় মতে "বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ আর গোমেধ", এই চার রকমেরই যজ্ঞ করার ই একমাত্র বিধান আছে কিন্তু রাজার পক্ষে এই চার যজ্ঞের কোনোটাই করা সম্ভবপর নয়, তখন যজ্ঞ না করতে পারার জন্য রাজা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েন সেইজন্যই রাজ-পুরোহিত রাজাকে আশ্বস্ত করে যজ্ঞের বদলে দুর্গাপূজা করতে বলেন। রাজা কংস নারায়ণ তারপর দুর্গাপূজার আয়োজনও করেছিলেন বাংলাদেশে। শোনা যায় এই পূজার জন্য খরচ হয়েছিল প্রায় আট লক্ষাধিক টাকা। অধিকাংশ গবেষকের মতে সেই প্রথম দুর্গাপূজার শুরু এই অবিভক্ত বাংলাদেশে।                      
সেই যুগে দুর্গাপুজোয় মেষ, ছাগ, মহিষ, হরিণ, শূকর এমনকি গন্ডার, বাঘ ও  বলি দেওয়া হতো বলে শোনা যায়। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে নরবলিরও নাকি দেওয়া হতো, সত্য মিথ্যা আজ আর কোনো ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তাই সব ই প্রচলিত গল্পের মতো!
আবার আর একটি প্রচলিত গল্প শোনা যায় যে, মোগলরা যখন প্রথম বাংলাদেশের ঢাকায় আসে, তখনও নাকি এখানে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। গল্প না ইতিহাস গবেষকরা বলবেন! আমি শুধু দুর্গাপুজোর প্রাচীন কাহিনী আর প্রচলিত গল্প ই বলবো।                                                    1610 সাল, মোগল সুবাদার ইসলাম খান যখন বাংলার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এসে নামলেন, তিনি সেই সময় দেখতে পান সেখানে দুর্গাপূজা হচ্ছে, ঢাকীরা ঢাক বাজাচ্ছেন। এই ঢাক বাজানোর শব্দ শুনেই নাকি তিনি বাংলার নতুন রাজধানী ঢাকার আয়তন ঠিক করেছিলেন, শহরের তিন দিকে ঢাকীদের ঢাক বাজাতে বাজাতে চলে যেতে বললেন আর ঢাকের আওয়াজ যতদূর থেকে শোনা যাবে ঠিক তত দূরত্ব পর্যন্তই হবে ঢাকা শহরের পরিধি। আগেই বলে নিয়েছি কিন্তু, আমি শুধু গল্প বলবো!  তবে এটাও ঠিক যে, বহু প্রাচীন কাল থেকেই ঢাকায় এবং সারা বাংলাতেই দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল যদিও দুর্গাপূজা তখন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি কারন এই পূজো বেশ ব্যয়বহুল ছিল, শুধু ধনী রাজা বা জমিদারদেরই এই পূজার আয়োজন করার সামর্থ্য ছিল। দুর্গাপূজা বাংলাদেশে জনপ্রিয় বা সর্বজনীন হয়ে উঠতে কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ভারতের শাসক ইংরেজদের রাজধানী কলকাতাতেও বেশকিছু অভিজাত হিন্দু জমিদার ছিলেন যাদের সঙ্গে ইংরেজদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল, আর সেই জমিদারদের হাতেও বিস্তর  টাকাকড়িও ছিল ফলে কলকাতা ও অন্যান্য জনপদেও দুর্গাপূজা তাই অন্যান্য উৎসবের মতো নিজস্ব মান-মর্যদা, ক্ষমতা-প্রদর্শন আর জমিদারদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাড়াঁয়। এই উৎসবে ঘটা করে শাসকগোষ্ঠী ইংরেজদের আমন্ত্রণও জানানো হতো! ফলে উৎসবের ব্যাপকতা আর জাঁকজমক নিয়ে জমিদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমশ। তবে এটা অনস্বীকার্য যে দুর্গাপুজোর ধর্মীয় অনুভুতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর প্রতিযোগিতা, নিজেদের জমিদারি জৌলুস প্রজাদের কাছে দেখানোর এক প্রচেষ্টা! এটা ঠিক যে বাংলায় দুর্গাপূজা বহু প্রাচীন কালে শুরু হলেও আপামর হিন্দুদের কাছে এটি আজকের মতো বৃহত্তর হিন্দুদের কাছে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব হয়ে ওঠেনি সেই সময়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বিভিন্ন বিশ্লিষ্ট মানুষের আত্মজীবনীতে দূর্গা পূজার তেমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় না, সেই হিসেবে বলা যায়, তখনও এটি হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হতে পারেনি। পূর্ববঙ্গে তো এ কথা আরও প্রবলভাবে খাটে, পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর বা রাজধানী ঢাকাতে খুব একটা দুর্গাপূজার কথা শোনা যায় না। ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর 1839 এ, তার লেখা ‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ‘মহররম’, ‘বেরা’ এবং ‘বৈষ্ণ’ উৎসবের কথা বললেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছুই বলেন নি। একই ভাবে ঢাকার বাসিন্দা হৃদয়নাথ মজুমদারও তার লেখায় উনিশ শতকে দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছুই বলেননি, বরং ‘হোলি’, ‘ঝুলন’, ‘মহররম’এর মতো ধর্মীয় উৎসবের বর্ণনা তার লেখায় পাওয়া যায়। দুর্গাপূজা সেই সময় অবিভক্ত বাংলার রাজধানী  ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব না হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে বলেছেন, 'ঢাকা মূলত বৈষ্ণব শহর’, আর এ ধারাটি বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও বজায় ছিল।
সে সময়কার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘আট দশক’ বইতে লিখেছেন, “ঢাকার মতো বৈষ্ণব প্রধান শহরে সে সময় সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা ছিল না, ঢাকার আসল উৎসব ছিল ঝুলন আর জন্মাষ্টমী। শহরের মন্দিরগুলি ঝুলনের সময়ে উৎসবের সাজে সাজানো হতো।” ভবতোষ বাবু আরও লিখেছেন, “বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন তখনও হয়নি অন্তত ঢাকাতে।              
1946 এ নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং 1947 এ দেশ ভাগের পর ধনী হিন্দু পরিবার আর জমিদাররা বাংলাদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, তারপর থেকে ঢাকা বা বাংলাদেশে একক ও পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা করাটা একটু বেশ কঠিন হয়েই পড়েছিল, বিশেষভাবে বললে, জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার ফলেই বন্ধ হয়ে যায় বহু দুর্গাপূজা। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা  বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলেই কিন্তু চাঁদা তুলে সার্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা আয়োজনের সূচনা হয়।                         
কলকাতার দুর্গাপূজা বাঙালিদের বৃহত্তম উৎসব, কলকাতা বাঙালি হিন্দুপ্রধান মানুষদের শহর হওয়ায়, কলকাতার বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব এখন তাই এই দুর্গাপূজা। বর্তমান কলকাতার সবচেয়ে পুরনো দুর্গাপূজাটি হয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে। কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গাপূজাটি হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজা। তবে কলকাতায় বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা জনপ্রিয় হয় বিংশ শতাব্দীতে এসে। কলকাতায় এখন অসংখ্য সার্বজনীন পূজা হয় যার সংখ্যা পুরনো বাড়ির দুর্গাপূজার থেকে সংখ্যায় অনেক গুণই বেশি। আর কলকাতার দুর্গাপূজাকে সেই কারণেই পূর্ব গোলার্ধের রিও কার্নিভাল বলা হয়।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours