আপাতত চোখ সরানো গেল সিবিআই- রাজীব কুমারের কানামাছি খেলা থাকে। আর এ ব্যাপারে শাসকদলের সহায় হলো বামপন্থীরা।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ কেড়ে নিলো যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। মারমুখী অতিবিপ্লবী বামপন্থী ছাত্রছাত্রীরা সভ্যতার যাবতীয় সীমা ছাড়িয়ে গেলেন। অবাধে কিল, চড়, ঘুষি চালালেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র ওপর।
নাগাড়ে প্রায় ছ'ঘণ্টা ঘেরাও হয়ে থাকার পর, খোদ রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে।
ইউনিভার্সিটির অতিবিপ্লবী বামপন্থী ছাত্রদের তাণ্ডব নিয়ে মুখ খুললেন না রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছ'ঘণ্টা মারমুখী ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাওয়ে আটকে থাকা নিয়েও নীরব তিনি। উল্টে তিনি সওয়াল করে বসলেন রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েই। দেগে দিলেন রাজনৈতিক পক্ষপাতের সিলমোহর।
ওদিকে ঘটনার পেছনে শাসকদল বা বিজেপি'র হাত দেখতে পেলেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। তাহলে এখন কি এফএফআইয়ের আনুগত্য বদলে গেছে? কী বলেন সুজয়বাবু? এখানেই এক অদ্ভুত মিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তীর কথায়। তাঁরা কেউ অতিবিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের জঙ্গি আন্দোলন নিয়ে একটাও কথা বললেন না।
বরং এরইমধ্যে ভিন্নসুর শোনা গিয়েছে পরিষদীয় প্রতিমন্ত্রী তাপস রায়ের গলায়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আটকে রেখে কোনও নায়কোচিত কাজ করা হয়নি।
ঠিক এরকমই এক সুযোগের জন্য হা- পিত্যেশ করে বসেছিল শাসকদল, মত ওয়াকিবহাল মহলের। গত শুক্রবার থেকে মেডিয়া জুড়ে শুধুই রাজীব কুমার আর সিবিআই। যাঁর কাজ আসামীদের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে খুঁজে বার করা, সেই তিনিই রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের এডিজি নিজেই গা- ঢাকা দিয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সুকৌশলে জড়িয়ে দিয়েছিল রাজ্য প্রশাসনকেও। গত শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচানোর রক্ষাকবচ তুলে নেয়। পরমুহূর্ত থেকেই তাঁকে পাকড়াও করার জন্য সর্বস্ব পণ করে ময়দানে নেমে পড়ে সিবিআই। রাজীব কুমারকে ধরার জন্য সিবিআই অভিযানের একেবারে লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করে দেয় বৈদ্যুতিন মাধ্যম। টানটান উত্তেজনা। একেবারে ফিল্মি কায়দায়।
ওদিকে এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লিযাত্রা বিরোধী শিবিরের হাতে তুলে দিলো তোল্লাই ক্যাচ। সবমিলিয়ে গোটা ঘটনায় প্রতি মুহুর্তে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলো রাজ্যের শাসকদল। আপাতত সে ঘটনা থেকে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ, অসীম উৎসাহ সরিয়ে আনা গেলো যাদবপুর কাণ্ডে।
দেখতে না দেখতেই যাদবপুরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাংবাদিকরা। ক্যামেরা ঠিক রাজীব কুমার 'পাকড়াও অভিযান'- এর কায়দায়, তুলে আনতে লাগল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের লাইভ টেলিকাস্ট। এক নতুন উত্তেজনার ছবি। বদলে গেল প্রেক্ষাপট। আগে একতরফাই চাপে পড়ে গেছিলো তৃণমূল রাজ্য প্রশাসন। যাদবপুর কান্ডের পরেই জড়িয়ে গেল বিজেপি। জোর ধরল তৃণমূল বিজেপি রাজনৈতিক চাপান উতোর। রাজনৈতিক মহলের সমীকরণ বলছে, অতিবিপ্লবী বামপন্থীরা আপাতত খানিক স্বস্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারলো শাসকদলকে। তারপরেই আড়ালে চলে গেলেন বামপন্থীরা।
কিন্তু কেন এই খেলার ঘুঁটি সাজালেন সিপিএম? ঘনিষ্ঠ সূত্রের অনুমান, আসলে বিজেপি'র সঙ্গে সরাসরি টক্কর যাওয়ার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই বামপন্থী শিবিরের। তাই বাস্তববাদী বামপন্থী নেতারা বোঝেন, যা করার করতে হবে তৃণমূলের আড়ালে থেকেই। তাই তাঁরাও চান রাজ্যের ক্ষমতায় টিকে থাকুক তৃণমূল কংগ্রেস। নরমে গরমে টিকে থাকুক সম্পর্ক। মধ্যে মধ্যে ইস্যুভিত্তিক বিরোধিতা করলেই, দলের তৃণমূল বিরোধী ভাবমূর্তিতে শান দেওয়া হয়ে যাবে। পাশাপাশি চলতে থাকুক কিছু জঙ্গি আন্দোলন। বাজার গরম করে যদি রাজ্য- রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতায় আরও একবার ফিরে আসা যায়। আর এই ঝুঁকি নেবেই না কেন? এখন আক্ষরিক অর্থেই হারানোর মতো আর কিছুই নেই বামপন্থী শিবিরের।
কিন্তু বাবুল সুপ্রিয়ই বা কেন ওই ফাঁদে পা দিলেন? বৃহস্পতিবার ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে তো বোঝাই গেলো, গোটাটাই হয়েছে রীতিমতো ছক সাজিয়ে। এভিপিবি'র অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেলা পৌনে দু'টো নাগাদ বাবুল যখন ইউনিভার্সিটিতে পা রাখলেন, তার পরমুহূর্তেই ছাত্রছাত্রীদের ঢল নামলো। ঘেরাও হলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। কিভাবে? ঘটনায় পরিষ্কার, ওই ছাত্রছাত্রীরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন বাবুলের। আওয়াজ উঠলো "গো ব্যাক"।
দফায় দফায় হেনস্থা। চুল ধরে টানা, লাথি, ঘুষি, চড়- চাপড় চললো এক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ওপর। ঘটনার জল কোমড় ছাপিয়ে ওপরে ওঠার পর, ঘটনাস্থলে এলেন সপার্ষদ উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। বাবুল বললেন, "অনেক আগেই আপনার এখানে আসা উচিত ছিল। তাহলে ঘটনা এতদূর গড়াত না।" ওদিকে বিজেপি'র আরেক নেত্রী অগ্নিমিত্রা দলেরও অভিযোগ, তাঁর শাড়ি ধরে টানাটানি করা হয়েছিল।
রাজ্য পুলিসের ওপর এত অনীহা কেন উপাচার্যের? মারমুখী অতিবিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের কবজা থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে উদ্ধার করতে তিনি পুলিস ডাকতে রাজি হননি। এমনকি রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় যিনি আবার পদাধিকারবলে ইউনিভার্সিটির আচার্য, তাঁর নির্দেশ সরাসরি উপেক্ষা করেন তিনি। জানিয়ে দেন, পদত্যাগ করবেন, তবু ক্যাম্পাসে পুলিস ঢুকতে দেবেন না। এরপরেই ক্যাম্পাসের ওই চরম উত্তেজনার মধ্যেই, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ছাড়েন উপাচার্য। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক সহ- উপাচার্যও। এরপরেই গোটা ক্যাম্পাস আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। আর ওই অশান্ত অবস্থার মধ্যেই ঘেরাও হয়ে বসে থাকেন বাবুল।
ওদিকে তাদের নেতাকে হেনস্থা হতে দেখে মেজাজ হারায় বিজেপি'র ছাত্র সংগঠন। তছনছ করে দেওয়া হয় এসএফআইয়ের দপ্তর। তবে গোটা ঘটনাতেই ক্যাম্পাসে হাজির কিছু পুলিশকর্মীর ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। এই অভিযোগ সংঘর্ষরত দুই ছাত্র সংগঠনেরই।
ঘটনার কথা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কয়েক দফা কথাও হয় রাজ্যপালের। অভিযোগ এরপরেও বাবুল সুপ্রিয়কে মারমুখী ছাত্রছাত্রীদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য কোনও পদক্ষেপ করেনি রাজ্য প্রশাসন। অগত্যা রাজ্যপাল নিজেই পৌঁছে যান যাদবপুর ক্যাম্পাসে। দু'বারের চেষ্টায় তিনি প্রায় ছ'ঘণ্টা ঘেরাও হয়ে থাকা বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করে নিজের গাড়িতে নিয়ে বসান। ওদিকে নাছোড়বান্দা ছাত্রছাত্রীরা রাজ্যপালের গাড়ি ঘেরাও করে বসে থাকেন। ঘণ্টাখানেকের বেশি অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিস কার্যত আন্দোলনকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে রাজ্যপালের গাড়ি বার করে দেন। এই ঘটনার মিনিট দশেক পরেই ক্যাম্পাসের দখল নেয় র্যাফ।
রাজ্যপালের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যাওয়া নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য- রাজ্যপাল সংঘাত। বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতিতে মেতেছে দু'পক্ষই। শুক্রবার সকাল থেকেই রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। নতুন উত্তেজনায় ফুটছে শহর। আড়ালে চলে গিয়েছে সিবিআই- রাজীব কুমারের চোরপুলিশ খেলা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours