মহ: এনামুল হক, ফিচার রাইটার, বর্ধমান:

বর্ণ ব্যবস্থা শুধু মাত্র হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়,  মুসলমানদের মধ্যেও প্রকট ছিল এবং আজও তা আছে সমান ভাবেই। একটা সময় বর্ণহিন্দু এবং আশরাফ মুসলমানরা ফার্সি শিখত সরকারি পদের লোভেই।
মুর্শিদাবাদের মতো মুসলমানপ্রধান জেলাতেও ফার্সি শেখার ছাত্র মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু ছাত্র অনেক বেশি ছিল।
মুসলমান শাসকেরা বর্ণহিন্দুদের বর্ণাশ্রমের ব্যাপারে কোনওরকম হস্তক্ষেপ করেন নি। নিম্ন বর্ণের হিন্দু এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের  পড়াশোনার জন্য কোনও ব্যবস্থা করেন নি।
বর্তমানে যেটা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সেটা 1779 সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রথম কলকাতা মাদ্রাসা নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
সেই সময় ঐ কলকাতা মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হলে, অভিজাত শ্রেণীর মুসলমান প্রমানের জন্য সার্টিফিকেট জমা দিতে হতো।
সাধারণ মুসলমানদের সেখানে তখন ভর্তি হবার কোনো সুযোগই ছিল না।
অতীতে মখশুদাবাদের নাম পরিবর্তিত হয়ে মুর্শিদাবাদ রাখা হয় মুর্শিদকুলি খাঁর নাম অনুসারে। তিনি ছিলেন কর্ণাটকী ব্রাহ্মণ সন্তান। ইস্পাহানের এক বণিক তাকে ক্রিতদাস হিসেবে ক্রয় করে নিয়ে যান।
পরে ঐ বণিকের সুপারিশেই তিনি অর্থাৎ মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলায় আসেন। 
এই সব মুসলমানরা সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা লাভের বিরোধী ছিলেন।
মুসলমান শাসকরা দেশি মুসলমানদের জন্য আলাদা করে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করেন নি।
অথচ আমাদের মতো সাধারণ বাঙালি মুসলমানরা কথায় কথায় বুলি আওড়ায় আমরা অর্থাৎ মুসলমানরা শাত শত বছর ধরে সমগ্র দেশ শাসন করেছি।
সেই সময় মুসলমান শাসকদের শাসন আমলে অখন্ড বাংলার উনিশ জন জমিদারের মধ্যে আঠারো জন ছিলেন অমুসলিম জমিদার।
আশরাফ মুসলমানরা নিম্ন বর্ণের অর্থাৎ আজলাফ মুসলমানদের ভীষণ ঘৃণার চোখে দেখতেন। ফলে তাদের দরবারে এই নীচু শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য কোনো পদে নিযুক্ত করতেন না।
এবার দেখে নেওয়া যাক আশরাফ আর আজলাফ কাদের বলা হতো।
(১)আশরাফ (Ashraf) শরিফ বা সম্ভ্রান্ত এবং উচ্চশ্রেণির মুসলমান। সৈয়দ, শেখ, মুগল, পাঠান, মল্লিক, মীর্জা এই সকল মুসলমান সম্ভ্রান্তরা আশরাফ মুসলমান সম্প্রদায় ভুক্ত।অবশ্যই মাথায় রাখবেন যাদের পূর্ব পুরুষরা বিদেশ থেকে আগত কেবল তাদের বংশধররা এই আশরাফ মুসলমান বলে চিহ্নিত হন।
তারা নিজেদের কে বহিরাগত আশরাফি বা শরিফি  মুসলমান পরিচয় দিয়ে থাকেন।
মুসলমান সমাজে সৈয়দ মুসলমানদের অবস্থান হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণের সমমান ধরা যায়।
বা অনেকেই সমতুল্য হিসেবেই পরিগণিত করে থাকেন।
(২)আজলাফ ( Azlaf)  বা আতরাফ মুসলমান। এই শ্রেণীর মুসলমানেরা 'কামিনা' বা ' ইতর' অথবা 'রযীল' নামেও পরিচিত ছিলেন।
আজলাফদের চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে
 (ক) শেখ মুসলমান এদের পেশা কৃষিকার্য। সমাজে এরা আজলাফদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
(খ) দর্জি, জোলা, ফকির এবং রঙ্গরেজ।
(গ) বারহি, ভাতিয়ারা, ছিক, চুড়িহার, দাই, ধাওয়া, ধুনিয়া, গদ্দি, কালাল, কষাই, কলু, কুনজরা, লাহেরি, মাহিফারোশ, মাল্লাহ, নালিয়া, নিকারি।
(গ) আবদাল, বাখো, বেদিয়া, ভাট, ছম্বা, দাফালি, ধোবি, হাজাম, মুচি, নগরিচ, নাট, পানওয়ারিয়া, মাদারিয়া, তুতিয়া।
(৩)আরজাল (Arzal) অবনমিত শ্রেণীর মুসলমান। যেমন: ভানর, হালালখোর, হিজরা, কাসবি, লালবেগি, মাঙ্গতা এবং মেহতর এই শ্রেণীর ভুক্ত।
এখানে একটা কথা বলি, তৎকালীন সময়ে কোনো কোনো স্হানে আবদাল এবং বেদিয়া মুসলমান সহ এদের কে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হত না এমনকি কবরখানা ব্যবহার করতেও দেওয়া হত না। আর এগুলো অবশ্যই মুসলমান শাসন আমলের সময়েই।
আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানদের সাথে আজলাফদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠত না।
বরঞ্চ উচ্চ বর্ণের হিন্দু থেকে যারা মুসলমান হতেন তাদের সাথে আশরাফ মুসলমানদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক আদানপ্রদান হতো। এবং তারাও আশরাফ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হত।
একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে।
"গত বছর আমি জোলা ছিলাম, এই বছরে আমি একজন শেখ এবং আগামী বছর আমি একজন সৈয়দ হব, নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানেরা তাঁদের প্রভাব - প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের নামের সঙ্গে বড় বড় পদবী সংযোজন করেন।
তাদের উদ্দেশ্য করেই এই চলতি কথার প্রচলন হয় :-
" আগে থাকে উল্লা তুল্লা শেষে হয় উদ্দিন
তলের মামুদ উপরে যায় কপাল ফেরে যদ্দিন।"
মুঘলদের সময় কাল থেকেই শহর অঞ্চলের আশরাফ মুসলমানেরা আরবী ফার্সি এবং উর্দু ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেদের কে স্বতন্ত্র করে রাখা শিখেছে এবং সেই ধারা আজও অনেকটাই আছে।
আজও আশরাফ মুসলমানরা আজও উর্দুতেই কথা বলেন এবং তা স্বাচ্ছন্দ্যেই করেন। সেই সময়কালেও তারা বাংলা ভাষা কে ঘৃণার চোখে দেখত।
নিম্ন শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের নাড়ির টান বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির।
গ্রাম বাংলার চিত্র থেকে আজও তা স্পষ্ট।
গ্রাম বাংলার মাটিতে বাঙালিকে বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদেরকে আজও উর্দু ভাষা স্পর্শ করতে পারেনি। এই বাংলার সাথে শিকড়ের সম্পর্ক বাঙালি মুসলমানদের।
"১৯০৫ সালে যখন বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল বঙ্গ-বিভাগ পরিকল্পনাটি ছিল হিন্দু কে মুসলমান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেবার ব্রিটিশ চক্রান্ত। কিন্তু ১৯৪৭ সালে মুসলমানরাই চাইল অবিভক্ত বাঙলা আর হিন্দুরা চাইল বাঙলা বিভাগ। ১৯০৫ সালে কার্জন যা চেয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে হিন্দুরা সেই প্রস্তাবকে কার্যকরী করল। "(তথ্য: ভারত কি করে ভাগ হলো )।
নীচু তলার হিন্দু মুসলমানদের মতামত কে মোটেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
সেই সময় কলকাতা থেকে মুসলমানদের স্ল্যোগান উঠতো উর্দুতে।" কান মে বিড়ি, মুমে পান, লড়কে লেংগে পাকিস্তান। "
১৯৪১ সালের" শ্যামা হক "মন্ত্রীসভার স্থায়িত্বও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নি। এতে বরঞ্চ ফজলুল হকের জনপ্রিয়তার ভাটা পড়ে আসে।
বাংলা ভাগের যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে আপামর বাঙালি।
"১৯৪৮ এর মধ্য জানুয়ারীতে দক্ষিণপন্থী বিধানচন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন এবং কিরণশঙ্করকে তাঁর মন্ত্রীসভায় যোগদানের আহ্বান জানালেন। কিরণশঙ্কর কলকাতায় চলে এলেন। ৫ই মার্চ তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ১৯৪৯ এর ২০ শে ফেব্রুয়ারী মারা যান। দেশ ভাগ প্রতিরোধে ব্যর্থতা, জন্মভূমি ও জমিদারি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অন্ততঃ দুটি কাজ করতে বাধ্য হওয়া তার উপর প্রচন্ড মানসিক চাপের সৃষ্টি করে থাকবে। অনভিপ্রেত ঐ দুটি কাজের মধ্যে একটি ছিল কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা, এবং অন্যটি পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া শরণার্থীদের আবাসনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা থেকে মুসলমান বাসিন্দাদের সরিয়ে নেবার একটি রাষ্ট্র্রীয় উদ্যোগের সাথে জড়িত হওয়া "।
"কেন্দ্রীয় শিল্প ও সরবরাহমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চাপে ডাঃ বিধান রায়ের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মুসলমান অধিবাসীদের সরিয়ে দেবার একটা চেষ্টা হয়েছিল। এই উদ্যোগের কথা ডাঃ রায় প্রথমে ব্যক্ত করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের এক সভায়। অন্নদাশঙ্কর রায় তখন মুর্শিদাবাদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সেই সুবাদে সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন।প্রস্তাবটিকে তিনি অবাস্তব বলে অভিহিত করেন ফলে বিধান রায় তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এর কয়েক দিন পরে কিরণশঙ্কর মুর্শিদাবাদ যান। অন্নদাশঙ্কর রায় তখনও তিনি মুর্শিদাবাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি স্মরণ করছেন যে, কিরণশঙ্কর রায় রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাঁকে যা বলেন তার মর্মার্থ এই যে, বিশ্বস্তসূত্রে তিনি জানতে পেরেছেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন, সুতরাং অমুক তারিখের মধ্যে সীমান্ত থেকে পঞ্চম বাহিনীকে অপসারণ করাটা জরুরী। শুনে অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন তিনি বরঞ্চ ইস্তফা দেবেন তবু অমন কাজ করবেন না। ফলে অন্নদাশঙ্কর ছুটিতে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় অন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এলেন। ইতিমধ্যে নেহেরু ফিরে আসায় মুসলমান উৎখাতের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। এর কিছু দিন পরে স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে অন্নদাশঙ্কর তাঁর আই সি এস সি চাকরীতে ইস্তফা দেন "।
শ্যামার দল হোক বা জিন্নাহর উর্দু ভাষী বাংলা ও বাঙালির শত্রু দের থেকে সাবধান।
যদি ঐ পদে ঐ সময়ে এমন একজন মানবিক মহান মানুষ ম্যাজিস্ট্রেট না থাকতেন। তবে সীমান্তবর্তী সকল বাঙালি মুসলমান সেই সময়েই শবে পরিণত হতো। যদি শ্রদ্ধা করতে হয়,  শ্রদ্ধার মহান আদর্শ কে করুন।
ম্যাজিস্ট্রেট অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো মানুষদের করুন।
শ্যামার সাগরেদদের ইতিহাস অনেক সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের অজানা।
উর্দুদের ইতিহাসও বাঙালি মুসলমানের কাছে অজানা।
রুপকথা দিয়ে নয়। ইতিহাস দিয়ে বিচার করুন।
তৃণমূল বা সিপিএমের উপর রাগ করে বিজেপির প্রতি অনেক মুসলমানদের দেখেছি বিচিপি র ঝান্ডা বইতে।
বাঙালি মুসলমানপ্রধান গ্রামে দেখেছি ইদানিং কালে শ্যামার জনম দিন পালন করা হচ্ছে মহা ধুমধামে।
মাহফুজা খাতুন দের মতো মোছলমান মহিলাদের দেখেছি মাথায় ঘোমটা টেনে বাঙালি মুসলমানদের মাথা গুলো চিবিয়ে খেতে।
উর্দু আর শ্যামাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

2 comments so far,Add yours

  1. শ্যামাপ্রসাদের জন্যই এপার বাংলার হিন্দুরা আজও বেঁচে আছে। ওপারের মুসলমানরা সমষ্টিগত ভাবে হিন্দুদের লুপ্ত করার কাজে ধার্মিক কুপ্ররোচণায় লিপ্ত।

    ReplyDelete
  2. নোয়াখালীর গণহত্যাসহ পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের গণহত্যাগুলো বাংলাভাষী ম্লেচ্ছগুলোই করেছিলো।

    ReplyDelete