দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
বাপ
কা বেটি নানুরের সেবিনা ইয়াসমিন। বোমাতংক যে নানুরের নামের সাথে যুক্ত হয়ে
আছে। সেখানকার অন্য পরিচিত মুখ সেবিনা। এক সময়ে বাবা লুৎফর রহমান প্রায়
কুড়ি বছর বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। আজ বাবা নেই। তাঁর মেয়ে সেই মানুষ গড়ার কাজ
করে যাচ্ছেন নীরবে। পড়ানো ছাড়াও পাপুড়ি গ্রামের বাউড়ি পাড়ায় দুঃস্থ বাগদি
ছেলে মেয়েদের বইপত্র কিনে দেন নিজের সামান্য রোজগার থেকে। বেশীরভাগ ছাত্র
ছাত্রীর কাছে পয়সা নেন না সেবিনা। তবুও আক্ষেপ, সামর্থ্য থাকলে কিছুই নিতাম
না। তবুও কয়েকজন কিছু কিছু করে দেয়। যদিও আমি নিজে চাই না। আমার আব্বা
সেটুকুও নিতেন না, এই আক্ষেপ কম নেয় সেবিনার গলায়।
সেবিনার
বাড়ি নানুর থেকে ৬ কিমি দূরে চারকোল গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরান্ডী গ্রামে।
বাড়িতে ষাটোর্ধ অসুস্থ মা হামিদা বেগম আর অসুস্থ দিদি সামিমা খাতুন। চার
বোনের মধ্যে দুই দিদির বিয়ে আগেই হয়েছে। বাড়িতে ছেলে না থাকায় ছোট বোন
সেবিনাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়। ২০০০ হাজার সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৫৪
শতাংশ, ২০০২ সালে উচ্চমাধ্যমিকে এবং ২০০৫ সালে স্নাতক স্তরে ৫০ শতাংশ
নাম্বার পান তিনি। ভোর সাড়ে চারটেয় আযান শুনে তাঁর ঘুম ভাঙে। মুখ ধোওয়া,
স্নান কোরান শরিফ পড়ে বেরিয়ে পরেন বাড়ি থেকে ৬ কিমি দূরে একটি বেসরকারি (আল
আমিন মিশনের শাখা) প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের পড়াতে যান। সেখানেই দুপুরে আহার।
যৎসামান্য আয় হয়। এসবের ফাঁকে ৫ ওয়াক্ত নামায পড়েন।
সেবিনা
জানায়, ক্লাসের পর বাচ্চাদের পড়াতে হয়। ফের বেলা তিনটা থেকে পাপুড়িতে এক
দোচালায় হিন্দুপাড়ায় বাচ্চাদের পড়ান। বেশীরভাগ দুঃস্থ বাগদিদের মেয়ে। নিজের
যৎসামান্য আয় থেকে কখনও কখন ও তাদের বই কিনে দিতে হয়। বছর খানেক আগে ওই
গ্রামের মনসা তলায় পড়াতেন। কিন্তু কোন ঠিকানা স্থায়ী হয় না তাঁর। বিভিন্ন
জায়গায় পড়িয়ে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে নার্সারি থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্র
ছাত্রীদের ৯টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পড়ান। স্নাতকে ইংরাজী প্রধান বিষয় থাকায়,
বেশী করে ইংরাজী পড়ান। পাশপাশি, বাংলা, ইতিহাস, ভুগোল, আরবি পড়ান তিনি। তার
পর একটু ভাত ফুটিয়ে দিনের তরকারী দিয়ে চালিয়ে নেন রাত্রের খাবার। এত
কষ্টের শিক্ষা পেয়েছেন আব্বার কাছ থেকে। তাঁর মুখে শোনা, লুতফর সাহেব
ইকনমিক্সে সাম্মানিক, স্নাতোকত্তোর এবং বিএড ডিগ্রি করে কলেজে পড়ানোর সুযোগ
হাতছাড়া করেছিলেন। শুধু গ্রামের জন্য। নিজের গ্রাম থেকে ৬ কিমি দূরে
পাপুড়ি হাই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাটি ও কাদার দেওয়ালে খড়ের ছাউনি
দেন লোকজনের সাহায্যে। স্কুলের জন্য দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে ১৯৯৫ সালে সরকারী
স্বীকৃতি আদায় করেন। তবে প্রধান শিক্ষক হিসেবে মাত্র ৫ বছর মাইনা পান লুতফর
সাহেব। ২০১২ সালে তাঁর ইন্তেকালের পর যৎসামান্য পেনশন আর সেবিনার টিউশনির
আয় থেকে চলে হামিদা বেগমের সংসার। তিনি জানান, লুতফর সাহেব ইংরাজীতে
সুপণ্ডিত ছিলেন। একটি ইংরাজি গ্রামারের লেখকও ছিলেন তিনি।
বাবার
কাছেই লেখাপড়া শেখা সেবিনার। যেটুকু জমি ছিল দুই মেয়ের বিয়ে দিতেই লুতফর
সাহেব নিঃস্ব হন। পরিবারের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেন নি তিনি। তবে আব্বার
আদর্শ সেবিনার কাছে অনেকটাই। তাই উদায়স্ত হাড় ভাঙা খেটে মানুষ গড়ার কাজে
লেগে আছেন। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে কাটছে তাঁর অফুরান সময়।
নিজের দিকে তাকাবার সময় ও অভ্যেস দুটোই নেই তাঁর।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours